‘উন্নয়ন স্বল্পদৈর্ঘ্যের দৌড় নয়, দীর্ঘমাত্রার পথযাত্রা’

প্রান্তিক মানুষসহ সবার জীবনমানের পরিবর্তনের জন্য ‘টেকসই’ উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2017, 03:42 PM
Updated : 6 April 2017, 03:42 PM

ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের এই পরিচালক বলেন, “উন্নয়ন যদি আমরা করি তাহলে সেই উন্নয়নকে বজায়যোগ্য হতে হবে। উন্নয়নের যে ধারা সেটা স্বল্পদৈর্ঘ্যের দৌড় নয়, এটি একটি দীর্ঘমাত্রার পথযাত্রা।

“সুতরাং সেটাকে যদি আমরা বজায়যোগ্য না করতে পারি, বজায়ক্ষম করতে না পারি তাহলে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো আমরা হঠাৎ করে দেখব যে আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি। এটা বিভিন্ন দেশে হয়েছে।”

বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘সবার জন্য মানব উন্নয়ন’ শীর্ষক বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক।

বক্তব্যে প্রান্তিক ও সবশ্রেণির মানুষের উন্নয়নে নীতিনির্ধারণের সময়ে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের পরামর্শও দেন ড. সেলিম।

তিনি বলেন, “নীতিমালার মধ্যে সার্বজনীনতা থাকতে হবে। অন্তর্ভুক্ত প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা যদি নারী ও বালিকাদের ক্ষেত্রে অন্তর্ভূক্তি করতে পারি, তাহলে সেটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও কাজ হয়ে যাবে।”

‘সার্বজনীন উন্নয়ন কৌশল থাকার পরেও’ প্রতিবন্ধীসহ বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার কথা বলেন সেলিম জাহান।

সবার ক্ষমতায়নের জন্য ‘মানবাধিকার, আইনের ক্ষেত্রে সকলের সমদৃষ্টি ও দৃশ্যমানতা নিশ্চিত করার প্রশ্ন থাকে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই জিনিসগুলো তাদের জন্য বেশি প্রয়োজন যারা প্রান্তিক অবস্থায় আছে। এটি কিন্তু একটি সাধারণ ব্যাপার নয়। এটি উন্নয়নের মৌলক কথা।”

সেলিম জাহান বলেন, “আমরা যখন মানব উন্নয়নের কথা বলি, তখন সেটার মধ্যে একটা সার্বজনীনতা আছে। কিন্তু আমরা অনেক ক্ষেত্রে সেই সার্বজনীনতা ভুলে যাই। মানব উন্নয়নের সার্বজনীনতার কথা বলছি, সেটা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, ভূখণ্ড, রাষ্ট্র সবকিছুকে ছাড়িয়ে প্রত্যেকটি মানুষের জন্য হতে হবে।”

সম্প্রতি প্রকাশিত ইউএনডিপির ‘মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৬’ অনুযায়ী মাথাপিছু আয়, গড় আয়ুসহ বিভিন্ন মাপকাঠিতে উন্নতির পথ ধরে মানব উন্নয়ন সূচকে তিন ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।

এবারের প্রতিবেদনে ১৮৮ দেশের মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩৯তম অবস্থানে। ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ১৪২তম অবস্থানে ছিল। 

২০১৫ সালে প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আয় ও সম্পদের উৎস, বৈষম্য, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও আর্থিক প্রবাহ, যোগাযোগ, পরিবেশের ভারসাম্য ও জনমিতির তথ্য বিশ্লেষণ করে এই মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করেছে ইউএনডিপি।

গত ২৫ বছরে বিশ্বের বা প্রত্যেকটি দেশের গড়ের দিক থেকে অনেক উন্নতি হলেও প্রচুর বঞ্চনা আছে বলেও মন্তব্য সেলিম জাহান।

বঞ্চনার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য, অসমতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো নতুনভাবে আবির্ভূত সমস্যাকে চিহ্নিত করেন তিনি।

তিনি বলেন, “আজকের পৃথিবীতে প্রতি তিনজন মানুষের মধ্যে একজন স্বল্প মানব উন্নয়ন স্তরে রয়ে গেছে। আমরা জানি, ১০০ কোটির বেশি মানুষ বহুমাত্রিক বঞ্চনার শিকার। সারাবিশ্বে প্রতি ঘণ্টায় আমরা ৩৫ জন মাকে হারাচ্ছি, সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে। এগুলো বড় রকমের বঞ্চনা।”

সারাবিশ্বে অসমতার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বের আটজন ধনী ব্যক্তির সম্পদ নিচের দিকের ৫০ ভাগ মানুষের সমান হওয়ার প্রসঙ্গে টানেন তিনি।

“সে হিসাবে যদি বলি, তাদের একজন ৪ কোটি ৬২ লাখ মানুষের সমান। অসমতার ব্যপ্তিটা সাধারণ এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায়। উপরের ১ শতাংশ যে মানুষ, তাদের সম্পদ বিশ্বের সকল সম্পদের ৪৬ ভাগ। এটা একটি বৈশ্বিক উপাত্ত। প্রত্যেকটি দেশের দিকে তাকালে সেটা বোঝা যাবে। অসমতাটা তীব্রতর ও গভীরতর হচ্ছে।”

সেলিম জাহান বলেন, “অসমতা কেবলমাত্র একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার নয়। অসমতটা একটি সামাজিক ন্যায়ের ব্যাপার। এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যদি দেখি, তাহলে দেখতে পাব.. প্রত্যেকের জন্য যে মানব উন্নয়ন হচ্ছে না, তার একটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অসমতা ও অসমতা গভীরতর হওয়া।”

মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিমাণের পাশাপাশি গুণগত দিকে জোর দেওয়া সবচেয়ে জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।ব্যক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি গোষ্ঠীগত সক্ষমতা বাড়ানোর উপরও জোর দেন এই অর্থনীতিবিদ।

মানব উন্নয়নে মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের নিয়ন্ত্রাণাধিকার প্রতিষ্ঠার উপরও জোর দেন সেলিম জাহান

“বৈশ্বিকভাবে আমরা দেখি, অনেক সময় দরিদ্র মানুষের জন্য আমরা নীতি নির্ধারণে বসি, কিন্তু সেই নীতি নির্ধারণী বৈঠকে তাদের স্থান নেই। শরণার্থীদের নিয়ে কী করা যায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে কিন্তু কোনো জায়গায় সেই আলোচনায় শরণার্থীরা নাই। তেমনিভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের শিকাররা সেখানে থাকে না।”

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ও ড. সেলিম জাহানের পরিচিত তুলে ধরেন পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মঈনুল ইসলাম।