রিজার্ভ চুরি: সহসা আলোর মুখ দেখছে না তদন্ত প্রতিবেদন

রিজার্ভ চুরি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের জন‌্য তারিখ দিয়ে আবারও তা অনির্দিষ্টকালের জন‌্য পিছিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2016, 08:54 AM
Updated : 21 Sept 2016, 11:27 AM

গত রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগেই বৃহস্পতিবার তিনি ওই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাবেন। কিন্তু বুধবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের ডেকে জানিয়ে দেন, সহসা ওই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে না। 

“এটা আমার ঘোষণা মত কালকে প্রকাশ করা হবে না। বেশ দেরি হবে… বেশ দেরি হবে।”

ফরাসউদ্দিন গত ৩০ মে ওই প্রতিবেদন দেওয়ার পর অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, রিপোর্টে যা আছে, তা অবশ‌্যই প্রকাশ করা হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কয়েক দফা সময় দিয়েও কথা রাখেননি মুহিত। এবার তিনি যুক্তি হিসেবে ফিলিপিন্সে টাকা উদ্ধারে মামলা চলার কথা বলেছেন।  

“ইতোমধ‌্যে এ বিষয়ে ফিলিপিন্স ও আমাদের মধ‌্যে আলোচনা চলছে। আমরা সেখানে মামলা মোকদ্দমা করেছি। ইত‌্যাদি নানান কিছু আছে। এই রিপোর্ট বেরুলে সেগুলো আপসেট হয়ে যাবে। সেজন‌্য রিপোর্ট এখন বের হচ্ছে না। পরে বের করব। তারিখ বলতে পারছি না। ইট উইল বি পাবলিশড।

গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশের এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি মেসেজে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপিন্সের একটি ব্যাংকে। আর আরেক আদেশে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয় ২০ লাখ ডলার।

শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থ ওই অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া শেষ পর্যন্ত আটকানো গেলেও ফিলিপিন্সের ব্যাংকে যাওয়া অর্থের বেশিরভাগটাই স্থানীয় মুদ্রায় বদলে জুয়ার টেবিল ঘুরে চলে যায় নাগালের বাইরে।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সাইবার চুরির এই ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে ঘটনার এক মাস পর, ফিলিপিন্সের একটি পত্রিকার খবরের মাধ্যমে।

বিষয়টি চেপে রাখায় সমালোচনার মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে আনা হয় বড় ধরনের রদবদল। 

ওই সময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মামলা করা হয়। ১৫ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি, যার প্রধান করা হয় সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনকে।

কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- বুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কীভাবে, কার বরাবরে ভুয়া পেমেন্ট ইন্সট্রাকশন পাঠানো হয়েছিল, অবৈধ পরিশোধ ঠেকাতে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল কি না, রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রায় এক মাস গোপন রাখা যৌক্তিক ছিল কি না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের অবহেলা ছিল কি না এবং অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা, গৃহীত কার্যক্রমের পর্যাপ্ততা ও পুনরাবৃত্তি রোধে গৃহীত ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কমিটিকে।

বেধে দেওয়া সময় অনুযায়ী গত ২০ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর কাছে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেয় ফরাসউদ্দিনের কমিটি। এরপর ৩০ মে দেওয়া হয় পুরো প্রতিবেদন।

প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর তদন্ত কমিটির প্রধান ফরাসউদ্দিন বলেছিলেন, রিজার্ভ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও সম্পৃক্ততা নেই বলে আগে তারা ধারণা করলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ওই অবস্থান থেকে ‘সামান্য’ সরে এসেছেন।

ভুয়া সুইফট মেসেজ পাঠিয়ে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সাইবার চুরির ওই ঘটনায় কারা কারা জড়িত, সে বিষয়ে তদন্ত কমিটি কী কী সুপারিশ করেছে- সে তথ্য প্রকাশ করেননি তদন্ত কমিটির প্রধান বা অর্থমন্ত্রী।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফরাসউদ্দিন শুধু বলেন, “সুইফটেরও দায় দায়িত্ব আছে, সম্পূর্ণ দায় বা মূল দায় তাদের কি না, সেই বিশ্লেষণও প্রতিবেদনে আছে। সুফইট কখনো দায় এড়াতে পারে না। তবে সুইফটের সাহায্য নিয়েই আমাদের ভবিষ্যতের প্রবলেমটা সলভ করতে হবে।”

চুরি যাওয়া টাকার কতোটা আদায় করা সম্ভব- তার একটা চিত্রও প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

ফরাসউদ্দিন বলেন, “বেশ ভালো একটা আশাব্যাঞ্জক চিত্র আমরা দিয়েছি।”

হাকিংয়ের এই ঘটনায় সুইফটের বিরুদ্ধে মামলার কথা বললেও পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই অবস্থান থেকে সরে গিয়েছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান ব্যাংকটির মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েক দফা সময় দেওয়ার পরও ওই প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশিত না হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিষয়ক সংসদীয় কমিটিও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেখতে চায়।

রিজার্ভ চুরির বিষয়ে ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটির তদন্তের মধ‌্যে কিম অং নামের এক ক্যাসিনো ব্যবসায়ী দেড় কোটি ডলার ফিলিপিন্স সরকারের হাতে ফেরত দেন।

ওই টাকা দেশটির এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলে জমা হওয়ার পর বাংলাদেশকে তা ফেরত দিতে আদালতে প্রক্রিয়া শুরু করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। সোমবার ওই অর্থ বাংলাদেশকে ফেরত দিতে বলা হয় দেশটির আদালতের এক আদেশে।

উদ্ধার হওয়া দেড় কোটি ডলার ‘দুই-এক দিনের মধ্যে’ হাতে পাওয়া যাবে বলে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বুধবার বলেন, ওই আলোচনার ভিত্তিতেই ‘টাকা ফেরত পাওয়ার স্বার্থে’ আপাতত প্রতিবেদন প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

“আরও অনেক বেশি টাকা পাইপ লাইনে আছে। তার শতভাগ আমাদের উদ্ধার করতে পারা উচিৎ।”

চুরি যাওয়া অর্থের মধ‌্যে আরও আট কোটি ডলার ফেরত পাওয়ার আশা করছেন জানিয়ে মুহিত বলেন, “বিভিন্ন ডিসকাসনে আছে, ৮০ মিলিয়ন ডলারের মত বোধ হয় ইজ আন্ডার কনসিডারেশন ফর রিকভার। এটাও ভাল, কারণ আমি প্রথম দিকে বলেছিলাম রিকভারি হবে-টবে না। সেখানে কৃতিত্ব দিতে হয় ফিলিপিন্স সরকারকে।”

ওই ৮০ মিলিন ডলার ফেরত পেতে কতদিন লাগতে পারে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বেশি দিন হলে ‘পুরনো হয়ে যায়’; তার আশা, চার মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে।