প্রকল্প আটকে দিচ্ছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংককে 

পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের যাত্রা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের বিলুপ্তির কথা থাকলেও তার মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব আসায় ব্যাংকের কাজে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

জাফর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 July 2016, 03:42 AM
Updated : 12 July 2016, 03:42 AM

প্রকল্পটির সমিতির তহবিল থেকে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যে গঠিত ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন জোগানোর কথা থাকলেও এই কারণে তা না পাওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে।

তাই ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটির তৃতীয় সংশোধনী অনুমোদন দিলে তার সম্ভাব্য জটিলতা দেখিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি পাঠিয়েছেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার।

অন্যদিকে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’র প্রকল্প পরিচালক আকবর হোসেন বলছেন, তারা প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন, এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের।

সমন্বিত গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কার্যাবলির কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়াসে ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

২০০৯ থেকে শুরু করে ২০১৪ সালে শেষের কথা থাকলেও পরে ব্যয় ১ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। এরপর দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় ৩ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় উন্নীত করে মেয়াদ ২০১৬ সালে জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

প্রকল্পের কর্মসূচি অব্যাহত রেখে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইন ২০১৪ পাস করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী গত ২২ জুন ব্যাংকটির ১০০টি শাখা উদ্বোধন করেন। অবশিষ্ট ৩৮৫ উপজেলায় শাখা খোলাসহ অন্যান্য যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে।

‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের সমিতিগুলো থেকে ৪৯ শতাংশ তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন জোগানের কথা ছিল।

এর মধ্যেই প্রকল্পটি বিলুপ্ত না করে আরও প্রায় ৫ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে ২০২০ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে তৃতীয়বারের মতো সংশোধন করতে প্রস্তাব পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ।

তার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য জটিলতার চিত্র তুলে ধরে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এ এন সামসুদ্দিন আজাদের কাছে সম্প্রতি চিঠি পাঠান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মিহির মজুমদার।

প্রকল্পটিতে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে তিনি লিখেছেন, জুনে প্রকল্পের সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পটি বিলুপ্ত হয়ে এর সম্পদ, দায়, কর্মসূচি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থানান্তরিত হওয়ার কথা। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি আইনানুগ নয়।

মিহির মজুমদার বলেন, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ৪০ হাজার ২১৪টি সমিতি ‘সময় সমিতি’ করার জন্য পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ থেকে একাধিকবার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গতবছরের ১৯ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত প্রকল্পর উপদেষ্টা কাউন্সিলের সভায়ও সমিতিগুলোকে ‘সময় সমিতি’ করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।

“কিন্তু একটি সমিতিও সমবায় সমিতি হিসাবে নিবন্ধন করা হয়নি। ফলে সমিতির অডিট হয় না, এজিএম হয় না, নির্বাচন হয় না এবং সমিতির নিজস্ব কোনো তহবিল গঠিত হয়নি।”

প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে সমিতিগুলো আরও দুর্বল হবে এবং প্রকল্পের ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের অনেক ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক চেয়ারম্যান।

চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “সমিতির নিজস্ব তহবিল সৃষ্টি হয়নি বিধায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমিতির অংশ (৪৯ শতাংশ) ৯৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করা যায়নি। এতে এ প্রক্রিয়া আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের পর্যালোচনা করে দেখিয়েছে, প্রকল্পে প্রতি সমিতিতে কৃষি, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপ্রাণী পালন, নার্সারী ও ফলচাষ বিষয়ে স্বেচ্ছাকর্মী সৃজনের জন্য ২ লাখ ২ হাজার ৬৩৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সংস্থান ছিল। কিন্তু মাত্র ৬৫ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

নতুন সংশোধনী প্রস্তাবে ১ লাখ সমিতির (পুরাতন ৪০ হাজার এবং প্রস্তাবিত ৬০ হাজার) জন্য ৫ লাখ সদস্যকে এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা সম্ভবপর নয় বলে মিহির মজুমদারের দাবি।

প্রকল্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য ১ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, যার ১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা ইতোমধ্যে সমিতিকে দেওয়া হয়েছে।

এ অর্থ অনুদান দেওয়া হলে তা ‘আত্মঘাতী’ হবে দাবি করে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলছেন, তাহলে সমিতিকে পরবর্তীতে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভবপর হবে না।

তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের সমিতিতে বর্তমানে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা ঋণ আছে। ঋণ আদায়ের হার কত তা কেউ জানে না, এমনকি প্রকল্প অফিসও জানে না। কোনো তদারকি ব্যবস্থাও নেই।

“কাজেই প্রকল্পের সমিতিগুলোকে এ ধরনের নাজুক অবস্থায় রেখে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি যৌক্তিক নয়। এসব সমিতি ও ঋণকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আনা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প গ্রহণ করাই যৌক্তিক,” লিখেছেন মিহির মজুমদার।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আকবর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রকল্পটি সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হলে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের আইন ভঙ্গ হয় কি না, তা দেখবে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।

“আমরা প্রকল্পের লক্ষ্য পূরণে আরও মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করেছি। তাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কাছে সংশোধনী প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এখন সংশোধন করবে কি না, তা সরকার সিদ্ধান্ত দেবে।”

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) আনন্দ চন্দ্র বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। এখন তারাই সিদ্ধান্ত দেবেন।”

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য এ এন সামসুদ্দিন আজাদ চৌধুরী উল্টো বলেন, “আইন ভঙ্গ হচ্ছে কি না, তা দেখবে মন্ত্রণালয়।

“এছাড়া আমরা প্রকল্পটির সংশোধনী পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে পাঠাব। উনি সিদ্ধান্ত নেবেন চূড়ান্ত সংশোধনের জন্য একনক সভায় তোলা হবে কি না।”