রিজার্ভ চুরি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততারও ইঙ্গিত মিলেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2016, 09:33 AM
Updated : 3 June 2016, 01:51 PM

তদন্ত কমিটির প্রধান সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সোমবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে এই প্রতিবেদন তুলে দেন।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ওই প্রতিবেদন পড়ে দেখে আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে তা প্রকাশ করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন।  

আর তদন্ত কমিটির প্রধান ফরাসউদ্দিন বলেছেন, রিজার্ভ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও সম্পৃক্ততা নেই বলে আগে তারা ধারণা করলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ওই অবস্থান থেকে তারা ‘সামান্য’ সরে এসেছেন। 

ভুয়া সুইফট মেসেজ পাঠিয়ে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সাইবার চুরির ওই ঘটনায় কারা কারা জড়িত, এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি কী কী সুপারিশ করেছে- সেসব বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি তদন্ত কমিটির প্রধান বা অর্থমন্ত্রী।   

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফরাসউদ্দিন কেবল বলেছেন, “সুইফটেরও দায় দায়িত্ব আছে, সম্পূর্ণ দায় বা মূল দায় তাদের কি না, সেই বিশ্লেষণও প্রতিবেদনে আছে। সুফইট কখনো দায় এড়াতে পারে না। তবে সুইফটের সাহায্য নিয়েই আমাদের ভবিষ্যতের প্রবলেমটা সলভ করতে হবে।” 

চুরি যাওয়া টাকার মধ্যে কীভাবে টাকা কতোটা আদায় করা সম্ভব- তার একটা চিত্রও প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

ফরাসউদ্দিন বলেন, “বেশ ভালো একটা আশাব্যাঞ্জক চিত্র আমরা দিয়েছি।”

গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশের এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি মেসেজে আট কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপিন্সের একটি ব্যাংকে। আর আরেক আদেশে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয় ২০ লাখ ডলার। 

শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থ ওই অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া শেষ পর্যন্ত আটকানো গেলেও ফিলিপিন্সের ব্যাংকে যাওয়া অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় বদলে জুয়ার টেবিল ঘুরে চলে যায় নাগালের বাইরে।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সাইবার চুরির এই ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে ঘটনার এক মাস পর, ফিলিপিন্সের একটি পত্রিকার খবরের মাধ্যমে। বিষয়টি চেপে রাখায় সমালোচনার মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের রদবদল আনা হয়।    

ওই সময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মামলা করা হয়। ১৫ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিটি, যার প্রধান করা হয় সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনকে।

এ কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- বুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কীভাবে, কার বরাবরে ভুয়া পেমেন্ট ইন্সট্রাকশন পাঠানো হয়েছিল, অবৈধ পরিশোধ ঠেকাতে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল কি না, রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রায় এক মাস গোপন রাখা যৌক্তিক ছিল কি না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের অবহেলা ছিল কি না এবং অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা, গৃহীত কার্যক্রমের পর্যাপ্ততা ও পুনরাবৃত্তি রোধে গৃহীত ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় এই কমিটিকে।

কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট ও ৭৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী গত ২০ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর কাছে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেয় ফরাসউদ্দিনের কমিটি। এরপর ৭৫তম দিনে সোমবার দেওয়া হল পুরো প্রতিবেদন। 

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন,  “ইটস এ ভেরি ইমপরটেন্ট রিপোর্ট, কেননা এটার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সংষ্কার। আমাদের অনেক ল্যাকেজ আছে, দোষ আছে, সেগুলো দেখানোই আসল উদ্দেশ্য।”

চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধার এ তদন্তের ‘উদ্দেশ্য নয়’, সেজন্য অন্যভাবে চেষ্টা হচ্ছে বলেও জানান মুহিত।  

তদন্ত কমিটির প্রধান ফরাসউদ্দিন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পেরে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ কাজে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব ধরনের সহযোগিতা তারা পেয়েছেন।

“অন্তর্বতীকালীন যে রিপোর্ট, সেটার সঙ্গে এটার বলতে গেলে প্রায় কিছুই মিলবে না। অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, একদম আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। ৯০ শতাংশ পরিবর্তন হয়ে গেছে।”

পরে এর ব্যাখ্যায় ফরাসউদ্দিন বলেন, আগের প্রতিবেদনটি ছিল ‘তাড়াহুড়োয়’ তৈরি। তাছাড়া প্রাথমিক প্রতিবেদন দেওয়ার পর বুয়েটের তিনজন শিক্ষকের সহায়তা নেওয়া হয়, যারা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ দিয়ে ‘অসাধারণ’ সহযোগিতা করেন। 

তিনি বলেন, বাইরের কোন ‘সাইবার অপরাধী’ এ ঘটনায় দায়ী, তা নির্ধারণ করা তদন্ত কমিটির পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কতোটা সম্পৃক্ততা সেখানে ছিল, তা অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন তারা।

“আগে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও কোনো সম্পৃক্ততা নাই। এখন একটু পরিবর্তন হয়েছে। তবে কি ধরনের, সেটা রিপোর্টে আছে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরও এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

আরও খবর-