বিনিয়োগই মূল চ্যালেঞ্জ, এডিপিতে চাই নজরদারি: জায়েদ বখত

নতুন বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি এডিপি বাস্তবায়ন কড়া নজরদারির মধ্যে আনার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 May 2016, 07:09 AM
Updated : 29 May 2016, 07:25 AM

তিনি বলেছেন, “আমার বিবেচনায় আগামী বাজেটের মেইন চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিৎ বিনিয়োগ বাড়ানো।একদিকে যেমন সরকারি বিনিয়োগের গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ যাতে বাড়ে সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।”

আর এভাবেই সরকার রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ অনেকটা মোকাবেলা করতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এই গবেষক।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট সংসদে উপস্থাপনের আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে  জায়েদ বখত দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ খরা কাটাতে তার এই পরামর্শ তুলে ধরেন।

আগামী ২ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন। ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের পরিকল্পনা ধরে এই বাজেট সাজানো হচ্ছে বলে এরই মধ্যে জানিয়েছেন তিনি। 

অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণার আগে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির হালচাল, ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এডিপি বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়েও কথা বলেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: অর্থমন্ত্রী এবার সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সেই বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী হবে বলে মনে করেন?

জায়েদ বখত: দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলা যায়। মূল্যস্ফীতি সহনীয়, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ভালো, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ধীরগতি থাকলেও রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।

কিন্তু সমস্যা বিনিয়োগে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিনিয়োগের যে খরা চলছে, সেটা কাটছে না। সে কারণেই আমি মনে করি, আগামী বাজেটের মেইন চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিৎ বিনিয়োগ বাড়ানো।

এখানে একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। সে কারণেই আমি নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রীকে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে অনুরোধ করছি। বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে বলছি…।

সরকারি বিনিয়োগের গুণগতমানের কথা বলছেন আপনি। এর সমাধান কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন।

প্রতিবছর সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বিশাল অংকের টাকা খরচ হয়। কিন্তু এই কাজের মান নিয়ে শুধু আমি নই, সরকারের শীর্ষ মহলের অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। সময়মতো কাজ শেষ হয় না। প্রকল্প সংশোধন করতে করতে ব্যয় বেড়ে যায়। শেষ  পর্যন্ত কাজ শেষ হলেও সেই কাজের মান ভালো হয় না। অল্প কিছুদিনের মধ্যে রাস্তা-ঘাট, সেতু-কালভার্ট, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে যায়…। অর্থবছরের শেষ দিকে এসে তড়িঘড়ি কাজ শেষ করা হয় বলেই এমন হচ্ছে।

এ অবস্থার মধ্যেও নতুন বাজেটে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার এডিপি ইতোমধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন বরাদ্দসহ হিসাব করলে নতুন এডিপির আকার দাঁড়াবে ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৯৭ হাজার কোটি টাকার এডিপি (স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন বরাদ্দ ছাড়া) হাতে নিয়েছিল সরকার। কিন্তু বাস্তবায়ন সন্তোষজনক না হওয়ায় গত এপ্রিলে তা থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করে  ৯১ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।

অতীতের মতো এবারও শেষ দুই-তিন মাসে তাড়াহুড়া করে এই সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে অর্থ খরচ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কাজের মান ভালো হবে না- এটা অনুমান করা যায়।এ থেকে আমাদের পরিত্রাণ দরকার। বাজেট বাস্তবায়নে প্রাক-প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রশসনিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে। অহেতুক যাতে প্রকল্প ব্যয় না বাড়ে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, কড়া নজরদারির মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগ বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে ‘তদারকি’ করতে হবে।

[চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৫১ দশমকি ৩৪ শতাংশ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এ হার সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরে এই বাস্তবায়নের হার ছিল ৫৬ শতাংশ]

আপনি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলছেন। কিন্তু সেটা কীভাবে বা কোন ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্ভব বলে মনে করেন?

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো আছে তা দূর করতে হবে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে; উৎসাহিত করতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমার একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সেটা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের এখানে বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান বাধা হচ্ছে জমি। জমির সমস্যা বিনিয়োগকে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু জমির অভাবে সেগুলো ঠিকঠাক মতো করা যাচ্ছে না। পিপিপি প্রকল্পের (সরকারি-বেসরকারি অংশিদারিত্ব প্রকল্প) কাজগুলোও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে জমির অভাবে।

গ্যাস-বিদ্যুতে সমস্যা আছে…। সেগুলোও দূর করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ভালো না। লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েও তা আদায় হবে কীনা- তা নিয়ে সংশ্রয় আছে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?

এখানেও আমি সেই বিনিয়োগের কথাই বলব। বিনিয়োগ বাড়লে অর্থনীতি সচল হবে। আর অর্থনীতি সচল হলে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।

[ চলতি  অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। দশ মাসের হিসাবে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে আছে এনবিআর। সে কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।]  

এবার বাজেট ঘোষণার আগেই মূসক বা ভ্যাট নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। আন্দালনের হুমকিও দিয়েছেন তারা।

নতুন ভ্যাট আইনে পহেলা জুলাই থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের যে বিধান রাখা হয়েছে তা একসঙ্গে না করে স্টেপ বাই স্টেপ (ধাপে ধাপে) করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। সব জায়গা থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেওয়া হলে এক ধরনের অরাজকতা দেখা দিতে পারে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বেশি সমস্যায় পড়বেন। মূল্যস্ফীতি বাড়ারও আশংকা রয়েছে। এ কথা ঠিক যে, মূসকের বড় ধরনের রাজস্ব ছাড়া বড় বাজেট বাস্তবায়ন করা যাবে না। কিন্তু দেশের বাস্তব অবস্থাও বিবেচনায় রাখতে হবে।

[চলতি অর্থবছর মূল বাজেটের মধ্যে মূসক থেকেই ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৬৪ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের।নতুন অর্থবছরে মূসক থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু আদায় শুরুর আগেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ভ্যাট আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।]

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্যের দাম কম। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে বলে আপনি মনে করেন?

তেল ও খাদ্যের কম দাম আমাদের অর্থনীতিতে এক ধরনের স্বস্তি এনে দিয়েছে। তাই এবারও অর্থমন্ত্রী বেশ স্বস্তির মধ্যে বাজেট দিতে পারছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাফল্যের কথা যদি বলা হয়, তাহলে প্রথমেই বলতে হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকার কথা।

কম দামে তেল কেনায় বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়ম করপোরেশন) সম্ভবত এই প্রথমবারের মতো লাভের মুখ দেখেছে। তেল আমদানির খরচ মেটাতে সরকারকে আগের মতো ব্যাংকগুলোতে ধরনা দিতে হচ্ছে না। এ খাতে কম বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। একইভাবে খাদ্যপণ্য আমদানিতেও কম খরচ হচ্ছে বিদেশি মুদ্রা।

এই যে ২৯ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ, তাতে এ দুই খাতে কম খরচই সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে।

[২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এপ্রিল শেষে এই হার দাঁড়িয়েছে তারও কম; ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। নতুন বাজেটে এই মূলস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ]

নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী বড় (মেগা) প্রকল্পগুলোর জন্য আলাদা বরাদ্দ বা বাজেটের কথা বলছেন।এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

সেটা ঠিক আছে; ভালো। সরকারের এ উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু হচ্ছে…। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এ ধরনের আরও অনেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে আমাদের।

নতুন বাজেটে সরকার পদ্মা সেতু, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী এই বড় বড় প্রকল্পের জন্য আলাদা বাজেটের যে কথা অর্থমন্ত্রী বলছেন, সেটাও ভালো বলে আমি মনে করি।

দেশে বেশ কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। নিকট ভবিষ্যতে একই পরিস্থিতি থাকবে বলে রাজনৈতিক মহলেও আলোচনা রয়েছে। এ অবস্থায় নতুন বাজেট বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কতটা সহায়ক হবে বলে মনে করেন?

বাংলাদেশ স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের সুফল পাচ্ছে- এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার মধ্যেও প্রবৃদ্ধির এই ধারা ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ। এখন ৭ শতাংশের ঘর আতিক্রম করছে…। এক্ষেত্রে অবদান রেখেছে স্থিতিশীলতা। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে আরও গতি সঞ্চার হবে।

[২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) তথ্য হিসাব করে যে তথ্য দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে এবার ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। নতুন বাজেটে এই প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।]

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনাকে ধন্যবাদ।

জায়েদ বখত: আপনাকেও ধন্যবাদ।