রিজার্ভ চুরি: ‘ঠাণ্ডা মেরে গেছে’ ম্যানিলার তদন্ত

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি যাওয়ার পর পেরিয়ে গেছে তিন মাসের বেশি সময়। ফিলিপিন্সের ব্যাংক হয়ে ক্যাসিনোর মাধ্যমে ওই টাকা হাতিয়ে নেওয়ার হোতারা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।  

>>রয়টার্স
Published : 24 May 2016, 08:30 AM
Updated : 24 May 2016, 12:59 PM

ওই ঘটনায় ফিলিপিন্সে কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। দেশটির ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকেও (এনবিআই)  পুরো মাত্রায় এ ঘটনার তদন্তে যুক্ত করা হয়নি। ফিলিপিন্সের সিনেট যে শুনানি শুরু করেছিল, গত সপ্তাহে তাও শেষ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।

কয়েকজন কর্মকর্তা ও বেসরকারি সংস্থার তদন্তকারী বলেছেন, ফিলিপিন্সে ওই অর্থের যাত্রাপথ অনুসরণ করে এই চুরির মীমাংসা করা সম্ভব হবে বলে তারা আশা করেছিলেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি যেন ‘অনেকটাই ঠাণ্ডা মেরে গেছে’।

তারা মনে করছেন, যারা এই চুরির হোতা, তারা ফিলিপিন্স সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা রাখে। দেশটির মুদ্রা পাচার আইনে যে দুর্বলতা আছে তার খুঁটিনাটি জেনেই ফিলিপিন্সকে তারা বেছে নিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির এই ঘটনাকে বলা হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বড় সাইবার চুরি। এ ঘটনাকে ব্যাংক হ্যাক করার সাধারণ কোনো ঘটনার মতো বিবেচনা করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন ম্যানিলাভিত্তিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গোয়েন্দা অগাস্টাস এসমেরালদা, যিনি কাজ করছেন দুটি  আন্তর্জাতিক ব্যাংকের হয়ে।   

“এটা এমন এক ঘটনা, যেখানে কেউ একজন টাকা চুরির জন্য হ্যাকার ভাড়া করেছে। সেই লোক ব্যাংক ব্যবস্থাপনা বোঝে, মুদ্রাপাচার আইনের ফাঁক চেনে, আর ক্যাসিনো সম্পর্কে জ্ঞান রাখে।”     

লাস ভেগাসের ক্যাসিনো ডাকাতির কাহিনী নিয়ে নির্মিত হলিউডি সিনেমা ওশান’স ইলেভেনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে এসমেরালদা বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা যেন “আধুনিক যুগের ওশান’স ইলেভেন। আমি এটাকে বলব ম্যানিলা টুয়েলভ।”

ফিলিপিন্সের আইন অনুযায়ী, ক্যাসিনোগুলো মুদ্রাপাচার প্রতিরোধ আইনের আওতায় পড়ে না। অর্থাৎ, খেলোয়াড়দের অর্থের সন্দেহজনক উৎস সম্পর্কে সরকারকে তথ্য দিতে তারা বাধ্য নয়।

গেইমিং ব্যবসাকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতেই ২০১৩ সালে ফিলিপিন্সের কংগ্রেস ক্যাসিনোকে ওই আইনের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে।   

ফিলিপিন্সের পুরনো ধাঁচের ব্যাংক সিক্রেসি আইনও তদন্তকারীদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই আইনের ফলে প্রায় সব ধরনের বিদেশি মুদ্রার অ্যাকাউন্ট ও লেনদেনের তথ্য গোপনীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  

হ্যাকাররা, যাদের এখনও চিহ্নিত করা যায়নি, গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার হ্যাক করে ভুয়া সুইফট মেসেজ পাঠায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে।  ৩৫টি মেসেজের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে তারা।

বেশিরভাগ চেষ্টা আটকে দেওয়া গেলেও চারটি মেসেজে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ঠিকই চলে যায় ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংক করপোরেশনের এক শাখায়। সেই ব্যাংক থেকে একটি রেমিটেন্স এজেন্সির হাত ঘুরে ওই অর্থের বেশিরভাগটা চলে যায় ক্যাসিনোতে।

এই লেনদেনে যারা জড়িত ছিলেন- ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ক্যাসিনোর জাংকেট অপারেটর- তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ফিলিপিন্স সিনেটের ব্লু রিবন কমিটি।    

জুয়ার টেবিলে

ম্যানিলার নামকরা ক্যাসিনোগুলোতে প্রতিদিন বিপুল অংকের টাকা লেনদেন হয়। সোলায়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনোর ভিআইপি রুমে জুয়ার টেবিলে এক মিলিয়ন হংকং ডলারের (প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার) গোলাপি চিপসও দেখেছেন রয়টার্সের প্রতিবেদক।  

ওই ক্যাসিনোর বড় খদ্দেরদের মধ্যে অর্ধেকই চীনা। সোলায়ার যাদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, সেই ব্লুমবেরি রিসোর্টস করপোরেশন বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে ২ কোটি ৯০ লাখের মতো তাদের ক্যাসিনোতে ঢুকেছে এবং এর প্রায় সবটাই জমা হয়েছে দুই জাংকেট অপারেটরের অ্যাকাউন্টে।  

এ ঘটনার তদন্তে থাকা ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটির প্রধান সার্জিও ওসমেনা বলেন, কেউ যদি ক্যাসিনোতে গিয়ে দশ লাখ ডলারের চিপস কেনেন এবং বাজি ধরে ১০ হাজার ডলার হেরে যান, তারপর বাকি নয় লাখ ৯০ হাজার ডলার তিনি কোনো বন্ধুকে দিয়ে দেন, তাহলে সেই বন্ধু বিনা প্রশ্নে সেই চিপস ভাঙিয়ে অর্থ নিয়ে যেতে পারেন। এরপর ওই অর্থ কোথায় গেল, তা অনুসরণ করার সুযোগ আর থাকে না। 

এনবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা  রয়টার্সকে বলেছেন, বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর যখন জানা গেল যে ওই অর্থ ফিলিপিন্সে ঢুকেছে, তখনই তারা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে তৈরি ছিলেন। কিন্তু ‘কোনো এক অজ্ঞাত কারণে’ উপরের মহল থেকে কোনো ব্যবস্থা না নিতে বলা হয়।

ফিলিপিন্সে এ ঘটনার তদন্ত করছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল, যাদের লোকবল ও সুযোগ সুবিধা সীমিত। অন্যদিকে পাঁচ হাজার এজেন্ট থাকার পরও এনবিআইকে এ তদন্তে রাখা হয়েছে কেবল সহযোগীর ভূমিকায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআইয়ের পরিচালক ভিরজিলিও মেন্ডেজ শুধু বলেন, “এই তদন্তে আমাদের দায়িত্ব খুবই কম।” 

এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের প্রধান জুলিয়া বেকেই-আবাদ এর আগে জানিয়েছিলেন, তার প্রতিষ্ঠানে কেবল নয়জন ফিনানশিয়াল অ্যানালিস্ট আছেন, যাদেরকে প্রতি মাসে কোটি কোটি ডলার লেনদেনের হিসাবে নজর রাখতে হয়। 

এ কাউন্সিলে কতজন তদন্ত কর্মকর্তা কাজ করছেন তা না জানালেও জুলিয়ার দাবি, লোকবল সঙ্কট তাদের তদন্তের ক্ষেত্রে বাধা হচ্ছে না।

এই তদন্তের গতিপ্রকৃতি দেখে হতাশা প্রকাশ করে সেই এনবিআই এজেন্ট ফিলিপিন্সকে তুলনা করেছেন আরেকটি মুদ্রা পাচারের স্বর্গ হিসেবে। 

এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল রিজল ব্যাংকের ওই শাখা ব্যবস্থাপক, সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টের মালিক এবং যে রেমিটেন্স কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ হাতবদল হয়েছে, তার মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেছে।

এছাড়া গেইমিং ফার্ম ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানির মালিক ও ম্যানিলার মাইডাস ক্যাসিনোর ভিআইপি এরিয়ার পরিচালক কিম অং এবং তার চীনা সহযোগী ওয়েইকাং জুকেও ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে।  

কিম অং সিনেট কমিটিকে বলেছেন, রিজল ব্যাংক থেকে আসা অর্থের প্রায় অর্ধেক তার ক্যাসিনোতে ঢুকেছে। তবে ওই টাকা যে চুরি করে আনা হয়েছে, তা তিনি জানতেন না।   

অং, রেমিটেন্স এজেন্সির মালিক ও রিজল ম্যানেজার- সবাই দাবি করেছেন, কোনো অন্যায় তারা করেননি। আর সরকারের পক্ষ থেকে সিনেট কমিটিকে জানানো হয়েছে, জুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।  

ম্যানিলার সাবেক মেয়র আলফ্রেডো লিমের মতো প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অংয়ের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সিনেটর পানফিলো ল্যাকসন, যিনি একসময় ছিলেন পুলিশ প্রধান, তিনিও রয়টার্সের কাছে অংকে ‘নিজের বন্ধু’ বলে স্বীকার করেছেন।  

সিনেট কমিটির শুনানিতে অংকে বেশ সহজ ভঙ্গিতেই জবানবন্দি দিতে দেখা গেছে। তিনি ইতোমধ্যে দেড় কোটি ডলার কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। বাকি টাকার বেশিরভাগটাই খদ্দেরদের চিপস কেনায় ব্যয় হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।  

সিনেট কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান সিনেটর রাল্ফ রেকটো বলেছেন,  ‘এই নেটওয়ার্কে চীনাদের যোগাযোগ দেখে’ মনে হচ্ছে, রিজার্ভ চুরির হোতাও কোনো চীনা নাগরিক।  

তবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লু ক্যাংক ওই ঘটনায় চীনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। 

সিনেট কমিটি তাদের শুনানি শেষে যে প্রতিবেদন দিতে যাচ্ছে, তাতে ‘দোষীদের শনাক্ত করার বদলে আইনি ঘাটতির বিষয়টিই’ বেশি গুরুত্ব পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর কমিটি আইন সংশোধনের কোনো সুপারিশ করলে তার বাস্তবায়ন হবে কি না- তাও স্পষ্ট নয়।

ওসমেনা বলছেন, আইনপ্রণেতারাই অনেকে ওই আইনের সংশোধন চান না, কেননা তাতে তাদের সম্পদের হিসাব নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।

সাম্প্রতিক নির্বাচনে ফিলিপিন্সের জনগণ নতুন একটি কংগ্রেস নির্বাচিত করেছে, যারা আসছে জুলাইয়ে দায়িত্ব নেবে। সেইসঙ্গে ফিলিপিন্সের নেতৃত্বে আসবেন নতুন একজন প্রেসিডেন্ট।

তবে রিজার্ভ চুরির বিষয়ে সিনেট কমিটির তদন্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন যে দুই সিনেটর, সেই ওসমেনা এবং তেওফিস্তো গুইংগোনা এবারের নির্বাচনে জিততে পারেননি।