রিজার্ভ চুরি: শালিকা প্রধানের দাবি, টাকা পেয়েছেন ‘বন্ধুর মাধ্যমে’

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া যে ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয়েছিল, তা এক ‘বন্ধুর’ মাধ্যমে শালিকা ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন কথিত সেই বেসরকারি সংস্থার প্রধান হ্যাগোডা গ্যামেজ শালিকা পেরেরা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 April 2016, 07:05 AM
Updated : 1 April 2016, 03:06 PM

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে তিনি দাবি করেছেন, শ্রীলঙ্কায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসহ কয়েকটি প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার কাছ থেকে ওই অর্থ তাকে এনে দেওয়ার কথা বলেছিলেন এক বন্ধু। বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া টাকা থেকে ওই অর্থ আনা হয়েছিল কি না- সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই।

হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ইতিহাসের অন্যতম বড় এই রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি গত ৪ ফেব্রুয়ারি ঘটলেও বিষয়টি আলোচনায় আসে ফিলিপিন্সে ওই টাকার একটি অংশ নিয়ে তদন্ত শুরুর পর।   

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউ ইয়র্কে গচ্ছিত বাংলাদেশের রিজার্ভের ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টায় ৩৫টি ভুয়া অনুরোধ পাঠায় হ্যাকাররা। এর মধ্যে ৩০টি আটকে গেলেও একটিতে ওই দুই কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলঙ্কার প্যান এশিয়া ব্যাংকে, পেরেরার শালিকা ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্টে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে ওই অর্থ শ্রীলঙ্কায় পৌঁছায় ডয়চে ব্যাংকের হাত ঘুরে। তাদেরই সন্দেহের কারণে শেষ পর্যন্ত শালিকার অ্যাকাউন্টের ওই অর্থ আটকে যায়।

অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধে প্রাপকের জায়গায় ‘ফাউন্ডেশন’ বানান ভুল থাকায় ডয়চে ব্যাংক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল। এর মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে, অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধটি ছিল ভুয়া।

অবশ্য আরও চারটি অনুরোধে ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ততোক্ষণে ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের চারটি অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে ক্যাসিনোর মধ্যে পাচার হয়ে যায় এর একটি বড় অংশ।

ফিলিপিন্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই অর্থ জালিয়াতির ঘটনায় দেশটির সিনেট কমিটিতে শুনানি হচ্ছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় অর্থ পাচারের চেষ্টা নিয়ে তথ্য পাওয়া গেছে সামান্যই।

শ্রীলঙ্কার আদালত শালিকা ফাউন্ডেশনের ছয় পরিচালকের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ ঘটনায় মামলাও হয়েছে।

দেশটির পুলিশ আদালতকে বলেছে, নিম্ন আয়ের পরিবারকে সহায়তার নামে ২০১৪ সালে শালিকা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে ব্যাংকে জমা দেওয়া নথিপত্রে। কিন্তু কলম্বোর যে বাড়ির ঠিকানা সেখানে দেওয়া হয়েছে, তা বন্ধ পাওয়া গেছে। ওই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগের অন্য কোনো মাধ্যমও পাওয়া যায়নি।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার ব্যবসায়ী পেরেরা তাদের সঙ্গেই প্রথম এ বিষয়ে কথা বলেছে।

তিনি দাবি করেছেন, তাকে বলা হয়েছিল, জাইকা তার প্রকল্পে ওই দুই কোটি ডলার দিচ্ছে। ওই টাকা যে অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে, তাও তিনি জানতেন। তবে জাইকার সঙ্গে তার ‘সরাসরি’ যোগাযোগ হয়নি। পুরো বিষয়টি করে দিয়েছেন তার এক ব্যবসায়ী বন্ধু, যার সঙ্গে জাপানের ‘ভালো যোগাযোগ’ আছে। 

রয়টার্স জানিয়েছে, পেরেরার বক্তব্য যাচাই করে দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। যে বন্ধুর কথা তিনি বলছেন, তার ফোন নম্বর ও ইমেইল ঠিকানা তিনি দিলেও সেই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।  

জাপান সরকারের উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা জাইকা বলছে, শালিকা ফাউন্ডেশন নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ধরনের সম্পর্কই নেই।  

জাইকার মুখপাত্র নাওইয়োকি নেমোতো রয়টার্সকে বলেছেন, “তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো লেনদেন নেই। ঋণ বা সহায়তার কোনো বিষয়ও নেই।”

টাকা গেছে পল্লী বিদ্যুতের নামে

৩৬ বছর বয়সী পেরেরার স্বামী রামায়ঙ্কা আর্চাইজি ডন প্রদীপ রোহিতা ধামকিন নিজেও শালিকা ফাউন্ডেশনের একজন পরিচালক। কলোম্বোতে পেরেরা যখন রয়টার্সকে ইংরেজি ও সিংহলিজ মিশিয়ে সাক্ষাৎকার দেন, তার স্বামীও তখন পাশে ছিলেন।

পেরেরা দাবি করেন, তারা খুবই সৎ মানুষ। কোনো ধরনের অবৈধ কাজের মধ্যে তারা নেই।    

তিনি বলেন, তার সেই বন্ধু হয় নিজে হ্যাকারদের শিকার হয়েছেন, নয়তো সে নিজেও চোরের দলে যুক্ত বলে এখন তার মনে হচ্ছে।

পেরেরা সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের একটি নোট রয়টার্সকে দেখিয়েছেন, যাতে লেখা রয়েছে, বাংলাদেশের পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড জাইকার কাছ থেকে ২০১০ সালে ঋণ হিসেবে নেওয়া ওই ২ কোটি ডলার পরিশোধ করার পর তা শ্রীলঙ্কায় শালিকার অ্যাকাউন্টে জমা করতে পাঠানো হয়েছে।

পল্লী বিদ্যুতের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন রয়টার্সকে বলেছেন, তাদের কাছ থেকে ওই অর্থ গেছে, এমন চিন্তাই ‘হাস্যকর’।

“তারা হয়তো বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সরকারি নাম ব্যবহার করেছে।”

কলম্বো পুলিশ বৃহস্পতিবার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়া একটি প্রতিবেদনে বলেছে, তারা পেরেরার সেই বন্ধুকে এরইমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সেই ব্যক্তি আবার এক জাপানি মধ্যস্থতাকারীর কথা বলেছেন, যিনি সেই তহবিলের যোগাড়যন্ত্র করে দিয়েছেন।

রয়টার্স জানিয়েছে, পেরেরার সেই বন্ধুর মতো তার সেই জাপানি মধ্যস্থতাকারীর বক্তব্যও তারা জানতে পারেনি। সেই মধ্যস্থতাকারীকে ফোন করা হলে তিনি বলেছেন, তিনি সফরে আছেন, সুতরাং ওই মুহূর্তে কথা বলতে পারছেন না।

পেরেরার ‘দুর্দশা’

পেরেরার দাবি, ব্যবসা নিয়ে তিনি দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।   

রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, প্রকাশনা, অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ, নির্মাণ ও ক্যাটারিংয়ের চারটি কোম্পানি আছে তার। ২০১৪ সালে প্রকাশনা ব্যবসায় ‘এতোটাই ক্ষতি হয়’ যে তিনি সব কম্পিউটার বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। এখন তাকে বিভিন্ন ইন্টারনেট ক্যাফেতে বসে ব্যবসার কাজ সারতে হয়, সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়।

এই নারীর ভাষ্য, জাপানি তহবিলের সন্ধান তাকে যে বন্ধু দিয়েছিলেন, তিনি তার বিদ্যুৎ ও অবাসন প্রকল্পের অংশীদার। গত এক বছর ধরে তিনি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছেন।  তিনিই গত ফেব্রুয়ারিতে জাইকা থেকে দুই কোটি ডলারের তহবিল এনে দেওয়ার কথা বলেন। শর্ত ছিল, ওই টাকা বিদ্যুৎ ও আবাসন প্রকল্পে খাটাতে হবে।   

আদালতে কলম্বো পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেরেরা তার ব্যাংককে জাপান থেকে দুই কোটি ডলার আসছে বলে জানিয়েছিলেন। অবশ্য প্যান এশিয়া ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তদন্তের অজুহাত দিয়ে রয়টার্সের কাছে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।   

তবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে পুলিশের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেরেরা ৭৭ লাখ ২০ হাজার ডলার তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে এবং ১ কোটি ১১ লাখ ২০ হাজার ডলার তার সেই অংশীদারের অ্যাকাউন্টে জমা করার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন।  

ওই নির্দেশনা দেওয়ার কথা স্বীকার করে পেরেরা রয়টার্সকে বলেছেন, দুই প্রকল্পে অর্থ যোগানোর জন্যই তিনি ওই ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। বাকি টাকা খরচ হতো সরকারের কর বাবদ।  

পুলিশ প্রতিবেদন বলছে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ওই টাকা শালিকার অ্যাকাউন্টে জমা হলেও এতো বড় অংক থেকে ব্যাংক তা ছাড় না করে ব্যাখ্যা চায়।

এরপর ৯ ফেব্রুয়ারি প্যান এশিয়া কর্তৃপক্ষ পেরেরাকে জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ওই টাকা ফিরিয়ে দিতে বলেছে।