কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুরি টের পায় একদিন পর

যুক্তরাষ্ট্রে গচ্ছিত রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ডলার যে হাপিস হয়ে গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা তা একদিন পর টের পেয়েছিলেন বলে মামলার এজাহারে বেরিয়ে এসেছে।

কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2016, 03:32 PM
Updated : 15 March 2016, 03:32 PM

বিষয়টি টের পেয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে ই-মেইল পাঠিয়ে অর্থ স্থানান্তর বন্ধ করতে ফেডারেল ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ককে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।

তবে ততক্ষণে সুইফট সিস্টেমের মাধ্যমে বেরিয়ে ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কার দুটি ব্যাংকে চলে যায় ১০ কোটি ডলার। শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২ কোটি ডলার আটকানো হলেও ফিলিপিন্সে যাওয়া অর্থ চারটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তোলার পর অধিকাংশই চলে যায় ক্যাসিনোতে।

এই ঘটনাটি প্রচারের আলোতে আনা ফিলিপিন্সের সংবাদপত্র ইনকোয়ারারের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৪ ফেব্রুয়ারিতে সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) মেসেজিং সিস্টেমে জালিয়াতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে ভুয়া নির্দেশনা পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থ স্থানান্তর হয়েছিল।

অর্থ খোয়ানোর বিষয়টি টের পাওয়ার পর তা অর্থ মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে চাপের মধ্যে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান মঙ্গলবার পদত্যাগ করার পর মামলাটি হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে এই মামলা করেন বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে করা এই মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে।”

এজাহারে জোবায়ের বলেছেন, গত ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ৩ মিনিটের মধ্যে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে কার্যালয় ছেড়েছিলেন। পরদিন অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি ৪ তারিখের সম্পাদিত লেনদেনগুলোর নিশ্চয়তা বার্তা সুইফট কক্ষে রাখা প্রিন্টারে প্রিন্ট হওয়ার কথা।

৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে নিজে কার্যালয়ে গিয়েছিলেন জানিয়ে জোবায়ের বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় সহকারী পরিচালক রফিক আহমদ মজুমদার লক্ষ্য করেন যে সুইফট সারভারে লগ করার পরও বার্তাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্ট হচ্ছে না।

তখন সমস্যাটি প্রিন্টিং সংক্রান্ত বলে মনে করেছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা। তাই পরদিন সমস্যার সমাধানের পরিকল্পনা করে সাপ্তাহিক ছুটির ওই দিন দুপুর সাড়ে ১২টায় কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যান তারা।

জোবায়ের বলেন, ৬ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকাল ৯টায় কার্যালয়ে ঢুকে তারা দেখতে পান যে সুইফট সফটওয়্যার চালু হচ্ছে না। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সফটওয়্যারটি বিকল্প পদ্ধতিতে চালু করা হলেও প্রিন্টিং সমস্যাটির সমাধান করা সম্ভব হয়নি।

তখন বিষয়টি একাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাকের হোসেন এবং মহা-ব্যবস্থাপক বিএইচ খানকে জানানো হয়।

“তাদের মৌখিক অনুমোদনক্রমে বিকল্প পদ্ধতি ম্যানুয়ালি বার্তাসমূহ প্রিন্ট করতে সক্ষম হই। বার্তাসমূহ স্বাভাবিক নিয়মে বাছাই করার সময় লক্ষ্য করা যায় যে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে তিনটি ভিন্ন ধরনের মেসেজের মাধ্যমে আরও কিছু জানতে চাওয়া হয়েছে।”

জোবায়ের বলেন, নিউ ইয়র্কের ব্যাংকের প্রথম বার্তাটি এসেছিল ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ২৪ মিনিটে, যা তারা ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রিন্ট নিতে পেরেছিলেন।

“সেখানে ১২টি লেনদেন সম্পর্কে কিছু জানতে চাওয়া হয়। অন্য দুটি মেসেজ আমাদের সিস্টেমের গ্রহণ ৬ ফেব্রুয়ারি দুপর ১২টা ৮ মিনিটে। সেখানে একটিতে ৪টি এবং অন্যটিতে ৩০টি লেনদেন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। চারটি পেমেন্টের ব্যাপারে অধিকতর স্পষ্টকরণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়।”

বাংলাদেশ ব্যাংক শুরু থেকে বলে আসছে, হ্যাকাররা ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে নিউ ইয়র্কের ব্যাংটিকে তহবিল স্থানান্তরের আদেশ দিয়েছিল, যা প্রতিপালিত হয়।

এজাহারেও দাবি করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম ব্যবহার করে অর্থ সরানোর আদেশ পাঠালে মেসেজের একটি ACK কপি (স্বীকারপত্র) সার্ভারে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু ছিল না।   

“তখন আমাদের সুইফট সিস্টেমে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে আশঙ্কা করি এবং সুইফট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি পর্যালোচনার অনুরোধ করি।”

৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর দেড়টায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংককে ই-মেইল পাঠিয়ে অনুরোধ করা হয়, তারা যেন পরবর্তী নির্দেশনা দেওয়া না পর্যন্ত বাংলাদেশের সব পেমেন্ট প্রক্রিয়া স্থগিত রাখে।

পরদিন ৭ ফেব্রুয়ারি রোববার টেলিফোনে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েও সেখানে ছুটি থাকায় তা করতে সক্ষম হননি বলে দাবি করেন জোবায়ের।

৮ ফেব্রুয়ারি সুইফটের নিয়মিত সার্ভার চালুর পর বিকালে চারটি অননুমোদিত বার্তার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, তখন সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যাংকগুলোতে তহবিল ছাড় না করতে বার্তা পাঠানো হয়।

ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের চারটি অ্যাকাউন্টে গিয়েছিল ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, শ্রীলঙ্কার প্যান এশিয়া ব্যাংকিং কর্পোরেশনে গিয়েছিল ২ কোটি ডলার।

একটি বানান ভুল দেখে শ্রীলঙ্কার ব্যাংক ওই অর্থ স্থানান্তর আটকে রাখায় বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ বেঁচে যায় বলে গণমাধ্যমেখবর এসেছে।

এই ঘটনার তদন্তে থাকা ফিলিপিন্স সিনেট কমিটির চেয়ারম্যানকে উদ্ধৃত করে ইনকোয়ারার বলেছে, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক ৮ ফেব্রুয়ারি অর্থ স্থানান্তর না করতে রিজল ব্যাংককে বার্তা পাঠালেও তা মানা হয়নি। তার মধ্যে অর্থ ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যায়।