হ্যাকে হারানো অর্থের একাংশ এখন ‘কোনো ব্যাংকেই নেই’

হ্যাকে হারানো রিজার্ভের ১০ কোটি ডলারের একটি অংশ ব্যাংকের বাইরে চলে গেছে স্বীকার করলেও তা ফেরত পাওয়ার আশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2016, 03:39 PM
Updated : 9 March 2016, 05:10 PM

তারা বলেছেন, শতাধিক মিলিয়ন ডলারের ৮১ মিলিয়ন ফিলিপিন্সের এবং ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলঙ্কার ব্যাংকে সরিয়ে নিয়েছিল হ্যাকাররা।

এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার ২০ মিলিয়ন ডলার ফেরত পাওয়া গেছে। তবে ফিলিপিন্সে যাওয়া অর্থের একটি অংশ ইতোমধ্যে ব্যাংক চ্যানেলের বাইরে চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা।

তারপরও ওই অর্থ ফেরতে আশাবাদ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, “আমরা আশা করছি পুরো টাকাই ফেরত পাব। কেননা ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সেখানে আদালতও এই টাকা উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে আদেশ দিয়েছে।”

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্টে গচ্ছিত থাকা অর্থ উদ্ধারে বুধবার বাংলাদেশে কার্যরত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকের পর একথা বলেন শুভংকর সাহা।

‘সাইবার সিকিউরিটি অন পেমেন্ট সিস্টেম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান, নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা এবং এই ঘটনা তদন্তে সম্প্রতি নিয়োগপ্রাপ্ত রাকেশ আস্থানা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।

২৮০০ কোটি ডলার রিজার্ভের একটি অংশ হ্যাকিংয়ের শিকার হয়ে হারানোর পর গভর্নর আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকের পর এই প্রথম সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শুধু ঘটনাটি জানিয়ে অর্থ উদ্ধারে তৎপরতার কথা বলা হয়েছিল। তাতে খোয়া যাওয়া অর্থের অঙ্ক কিংবা কতটুকু উদ্ধার হয়েছে, তা বলা হয়নি।

শুরুতে এই বিষয়টি সম্পর্কে অন্ধকারে থাকা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, এই অর্থ খোয়া যাওয়ার দায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকের এবং তা উদ্ধারের প্রয়োজনে মামলা করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি দি ফিলিপিন্স ডেইলি ইনকোয়ারার চীনা হ্যাকারদের হাতিয়ে নেওয়া ১০ কোটি ডলার ফিলিপিন্সে ঢোকার তথ্য প্রকাশ করলে তাতে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা উঠে আসে।

ফিলিপিন্সের ওই সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, ওই অর্থ সেখান থেকে ক্যাসিনোসহ একাধিক হাত ঘুরে অন্য দেশে পাচার হয়েছে।

শুভংকর সাহা বলেন, ৮১ মিলিয়ন ডলার (৮ কোটি ১০ লাখ ডলার) ফিলিপিন্সে গেছে। ২০ মিলিয়ন ডলার গেছে শ্রীলঙ্কায়।

“ফিলিপিন্সে যে অর্থ গেছে, তার একটি অংশ এখনও সেখানকার ব্যাংকে আছে। আর কিছু ব্যাংকের বাইরে চলে গেছে। শ্রীলঙ্কার ব্যাংকে যে ২০ মিলিয়ন ডলার গিয়েছিল, সে অর্থ আমরা ইতোমধ্যে ফেরত পেয়েছি।”

শ্রীলঙ্কায় পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে হিসাবে জমা হয়েছে কি না- এক সাংবাদিক জানতে চাইলে শুভংকর সাহা প্রথমে “জমা হয়েছে” জানিয়ে পরক্ষণেই বলেন, “এখনও জমা না হলেও সেটি জমা হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।”

ফিলিপিন্সে কার একাউন্টে এই অর্থ স্থানান্তর হয়েছে- জানতে চাইলে ডেপুটি গভর্নর রাজী হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “কার কার অ্যাকাউন্টে গেছে, সেই অর্থ কোথায় ব্যবহার করেছে, সেবিষয়ে সেখানকার অ্যান্টি মানি লন্ডারিং বিভাগ কাজ করছে।”

‘তদন্তের স্বার্থে’ এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে না চাইলেও শুভংকর সাহা বলেন, “আমরা এখনও এটিকে হ্যাকড মনে করছি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে।”

.প্রতীকী ছবি

ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কের মুখপাত্র ইতোমধ্যে দাবি করেছেন, তাদের সিস্টেমে হ্যাকিংয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

যার অর্থ দাঁড়ায় এই ঘটনার দায় বাংলাদেশ ব্যাংকেরই। তবে অর্থমন্ত্রী মুহিত এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকটিকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দিয়েছেন।     

বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা করবে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে ডেপুটি গভর্নর রাজী হাসান বলেন, আইনগত প্রত্যেকটি দিক তারা পর্যালোচনা করছেন। পরবর্তীতে কী করা হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

ঘটনার দুই সপ্তাহ পরও অর্থমন্ত্রীকে জানানো হয়নি কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তদন্তের স্বার্থে বিষয়টি সবাইকে জানানো হয়নি। তবে তদন্তের প্রয়োজনে সরকারের যে যে জায়গায় জানানো দরকার, সেটা জানানো হয়েছিল। যখন একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এল, তখন অর্থমন্ত্রীকেও জানানো হয়েছে।”

তদন্তের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাও রয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে এবং তাদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে বলেও বলা হচ্ছে।   

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা বলেন, “এটা আমরা জানি না।”

এই অর্থ উদ্ধারে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্থানা কাজ করছেন জানিয়ে তাকে সাংবাদিকদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন ডেপুটি গভর্নর রাজী হাসান।

সাংবাদিকরা তখন একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন তাকে। তার মধ্যে ছিল- যে উপায়ে অর্থ সরানো হয়েছে তাকে হ্যাক, না কি চুরি কোনটা বলা যাবে; এর সাথে কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ সম্পৃক্ত আছে; এই ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংক না ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক কোন দিক থেকে ঘটেছে?

অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আস্থানা বলেন, “বিষয়টির তদন্ত চলছে। এর মধ্যে কিছু বলা মুশকিল।”

যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্স সাইবার সিকিউরিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আস্থানা আগে বিশ্ব ব্যাংকে কাজ করতেন।

শুভংকর সাহা বলেন, রাকেশ আস্থানাকে ‘আইটি গভর্নেন্স স্পেশালিস্ট’ হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি গভর্নেন্স বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে পরামর্শ দেবেন।

বৈঠকে উপস্থিত একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সাইবার নিরাপত্তা বাড়াতে দেশের সব ব্যাংকের ‘ভালনারেবল অ্যাসেসমেন্ট’ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

“এছাড়া গভর্নর এই ঘটনায় আতঙ্কিত না হয়ে ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্কতার সাথে লেনদেন করার পরামর্শ দিয়েছেন।”