বিনিয়োগ খরা কাটাতে বাধা ‘সংস্কারে গতিহীনতা’

চলতি অর্থবছরের শুরুতে অনুকূল পরিবেশ থাকলেও সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে গতি না থাকায় বিনিয়োগ আশানুরূপ হয়নি বলে সিপিডির পর্যবেক্ষণ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2016, 02:22 PM
Updated : 3 Jan 2016, 03:26 PM

বেসরকারি এই গবেষণা সংস্থাটি রোববার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি-২০১৫-১৬ : প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন পর্যা‌লোচনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে একথা বলেছে।

সিপিডির মতে, বিনিয়োগ বাড়াতে জ্বালানি তেলের দাম, ব্যাংক নীতি সুদ হার ও টাকার মান কমাতে হবে। পাশাপাশি সরকারের সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে এডিপির মাধ্যমে সামাজিক ব্যয় বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে।

রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান উপস্থাপিত প্রতিবেদনে এই সুপারিশগুলো তুলে ধরা হয়।

অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে উন্নতি হলেও বিনিয়োগের খরা কাটছে না বাংলাদেশে, যা নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও নানা সময়ে হতাশা প্রকাশ করে আসছেন।

সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, গত পাঁচ মাসে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় ছিল। এর পাশাপাশি বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমেছে, সুদ হার কমেছে, টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল ছিল, মূল্যস্ফীতিও কম ছিল।

“এরকম ইতিবাচক পরিবেশের মধ্যেও বেসরকারি বিনিয়োগে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। এটা চিন্তার বিষয়। ....অর্থনীতিতে স্থিতি আছে, কিন্তু চাঞ্চল্য নেই।”

বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ না বাড়ার কারণ হিসেবে দেবপ্রিয় বলেন, “সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি সংস্কারের উদ্যোগে ঘাটতি থাকায় ব্যক্তি বিনিয়োগে এই ধীরগতি।”

তৌফিকুল বলেন, “যেসব সংস্কার দরকার, তার অনেকগুলো সরকারের এজেন্ডার মধ্যে আছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নে গতি নেই। যেমন শুল্ক ও কোম্পানি আইন ইত্যাদি। আর কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার।”

এসব সংস্কার না করলে বিনিয়োগ বাড়বে না এবং মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা কিংবা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যও অর্জিত হবে না বলে মনে করেন দেবপ্রিয়।

এডিপির ক্ষেত্রে প্রকল্প মানুষের বা অর্থনীতির কতটা কাজে লাগছে, তা দেখতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উপরও জোর দেন তিনি।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার উপর জোর দিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, “এখন বিশ্বব্যাপী খবর হচ্ছে, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না।”

ব্যক্তি বিনিয়োগকে সহায়তা করার মতো ব্যাংক খাত এই মুহূর্তে অনুপস্থিত বলে মনে করে সিপিডি। এজন্য ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে তারা।

দুর্নীতি দমনের বিষয়ে সিপিডির গবেষক ফাহমিদা খানম বলেন, “বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির বিষয়ে আমরা দেখলাম, দুদক ব্যাংকের শীর্ষ ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি।”

সিপিডি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদ হার (রেপো, রিভার্স রেপো) কমানোর সুপারিশ করেছে।

সংস্থাটি মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদ হার কমানো উচিত। কারণ ব্যাংক খাতের সুদ হার কমছে, মূল্যস্ফীতিও কম। এছাড়া ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ব্যবধানও (স্প্রেড) কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ আয়বাহী খাতে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। টাকার মান কমানো হলে তা অর্থনীতিকে চাঙা করবে বলেও মনে করে সংস্থাটি।

জ্বালানি তেল

জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে এক দশকে এখন সবচেয়ে কম থাকার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারও দাম সমন্বয় করতে পারে বলে সিপিডি মনে করে।

সংস্থাটি বলছে, জ্বালানি তেলের দাম ১০ শতাংশ কমালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ বাড়বে। আর মূল্যস্ফীতি কমবে শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। এতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।

তৌফিকুল বলেন, “২০১৩ সাল থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে কমানো হয়নি। ভারত ইতোমধ্যে স্থানীয় বাজারে দাম সমন্বয় করেছে।”

বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি জানিয়ে এলেও তাতে অর্থমন্ত্রীর সাড়া মিলছে না। পুরনো দর ধরে রেখে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের এত দিনের লোকসান কমিয়ে আসার কথাও বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।

তৌফিকুল বলেন, “বিপিসি ১৫ বছর টানা লোকসান দেওয়ার পর গত অর্থবছরে ৫ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা লাভ করেছে। বর্তমান দাম অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে লাভের পরিমাণ ১১ হাজার কোটি টাকা হবে।

“কিন্তু বিপিসি এই লাভের টাকা কোথায়, কীভাবে ব্যয় করছে, সেটি স্পষ্ট না। বিপিসির ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে, তার কতটা সমন্বয় হয়েছে বা সরকার কী পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে, তা স্পষ্ট না।”

তবে সিপিডি ডিজেল, কেরোসিন ও ফার্নেস অয়েলের দাম বেশি হারে কমানোর পক্ষে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে সিপিডি বলছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো গেলে এলএনজি বা অন্য উপায়ের তুলনায় সরকারের সাশ্রয় হবে। তবে এজন্য অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে।

বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সরবরাহ লাইনের উন্নয়নের পরামর্শ দিয়েছে সিডিপি। সেইসঙ্গে গ্যাস কূপ খননের উপরও জোর দিয়েছেন তারা।    

তৈরি পোশাক

তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।

সংস্থাটি বলছে, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি বাড়ায় তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি বাড়ছে। কিন্তু আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানির চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভিয়েতনামের কোটা ও শুল্ক মুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বড় প্রতিযোগী হচ্ছে ভিয়েতনাম। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য এখন ১০ থেকে ১৪ শতাংশ শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করে, আর ভিয়েতনামের পণ্য প্রবেশে শুল্ক দিতে হয় ১১ থেকে ১৫ শতাংশ। কিন্তু নতুন একটি বাণিজ্যিক জোট হওয়ায় সেটা শূন্য শতাংশে নেমে আসবে। তখনই বাংলাদেশ বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।