রিজার্ভ: খাদ থেকে উঠে আসার গল্প

বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এলে ‘ভাবমূর্তি নষ্ট হবে’ বলে ২০০১ সালে প্রথমবারের মত এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল বাকি রাখতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ। ১৫ বছরের মাথায় সেই রিজার্ভ ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের মাইলফলক ছুঁতে চলেছে।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Oct 2015, 06:39 AM
Updated : 26 Oct 2015, 07:04 AM

এই হিসেবে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে সাতাশ গুণ। চলতি সপ্তাহে তা প্রথমবারের মত ২৭ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান জানিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, রোববার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। ৩০ অক্টোবর আইএমএফের ইসিএফের পঞ্চম ও ষষ্ঠ (শেষ) কিস্তির প্রায় ২৬ কোটি ডলার রিজার্ভে যোগ হবে।

“তখন অথবা তার আগেই রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আর এটা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক,” বলেন ছাইদুর।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারার কারণে গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ বাড়ছে। এছাড়া জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্য আমদানি খাতে খরচ কম হওয়ার কারণেও রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

গভর্নর আতিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্তোষজনক রিজার্ভ আছে বলেই পদ্মা সেতু নির্মাণে বিদেশি কেনাকাটায় বিল পরিশাধে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষদিকে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। এরপর বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন রিজার্ভে ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি।

সে সময় আকুর বিল বাবদ ২০ কোটি ডলার পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু তাতে রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসত। আর রিজার্ভ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ দাতাদের সহায়তা পাওয়া যাবে না- এই বিবেচনায় আকুর দেনা পুরোটা শোধ না করে অর্ধেক দেওয়া হয় তখন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ওই একবারই আকুর বিল বকেয়া রাখা হয়েছিল বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশকে দুই মাস পরপর পরিশোধ করতে হয় আকুর বিল।

প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয়ের খরচ হিসাবে হাতে থাকা রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

বাংলাদেশের রিজার্ভ বৃদ্ধির এই পর্যায়ের সঙ্গে ভারতের নব্বইয়ের দশকের মিল খুঁজে পান বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু।

চলতি মাসের শুরুতে লিমায় বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলন চলাকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আর্লি নাইনটিজের কথা, ভারতের রিজার্ভ ৭ বিলিয়ন ডলার হলে বলা হত খুব ভালো সময় যাচ্ছে। তারপর ইন্ডিয়ার রিফর্মের পর রিজার্ভ বাড়তে শুরু করল চড়চড় করে…। বাংলাদেশেও সেটা দেখা যাচ্ছে। ২৭ বিলিয়ন ইজ অ্যা ভেরি হ্যান্ডসাম ফিগার।”

ভারতীয় এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “রিজার্ভ ভাল থাকলে স্পেকুলেটররা ভয় পায়। কারণ ওরা জানে সেন্ট্রাল ব্যাংকের হাতে একটা পাওয়ার আছে, একটা বিরাট অ্যামুনিশন আছে। সো ইটস আ ভেরি গুড নিউজ।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ১৪ অক্টোবর রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে তা প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে।

গত ১৭ অগাস্ট রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এই সঞ্চয়ন ১৫ বিলিয়নের ঘর ছাড়িয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ মে। আর ১০ বিলিয়নের মাইলফলকে পৌঁছেছিল ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের আকুর বিল নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধ করতে হবে। তখন অবশ্য রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে। এবার আকুর বিল বাবদ ৯০ কোটি ডলার শোধ করতে হবে বলে  ছাইদুর রহমান জানান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স বাংলাদেশে এসেছে। ওই অংক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

তবে চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ রেমিটেন্স কম এসেছে। এই তিন মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে দশমিক ৮৩ শতাংশ।