শিক্ষক হত্যা-হেনস্তার প্রতিবাদ চট্টগ্রামে

শিক্ষক হত্যা ও হেনস্তার ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে চট্টগ্রামে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2022, 05:22 PM
Updated : 29 June 2022, 05:22 PM

বুধবার বিকালে নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে ‘সর্বস্তরের সংস্কৃতি কর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম’ ‘সাম্প্রদায়িক বর্বরতার অবসান চাই, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই’ স্লোগানে এই কর্মসূচি আয়োজন করে।

সমাবেশে কবি-সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, “সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতাও আছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা, সবক্ষেত্রে একই।

“সমাজে শিক্ষকদের মতামতের একটি গুরুত্ব আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষককে অপমান তাই সমাজে বার্তা দেয়। ৭৫’র পরে অসাম্প্রদায়িকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পর বাংলাদেশের বিপরীত যাত্রা শুরু হয়।”

সমাজের ভেতর সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা বিস্তার লাভ করেছে মন্তব্য করে আবুল মোমেন বলেন, “ধর্মভিত্তিক দলগুলো এতে ভর করে আগাচ্ছে। আওয়ামী লীগ প্রগতিশীলদের সঙ্গে রাখছে, আবার জামায়াত-হেফাজত ধর্মান্ধদেরও সাথে রাখতে চায়।

“একাত্তরে এই আপস হয়নি। আবার পাকিস্তানের ভূত চাপানোর চেষ্টা চলছে। এটা এ দেশে চলবে না। সমাজে প্রতিবাদী চেতনা জাগছে। সর্বস্তরের মানুষ সাড়া দেবে। যারা এর জন্য ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত তাদেরও আসতে হবে। আজ বৃহত্তর নাগরিক ঐক্য দরকার। যার মধ্যে দিয়ে একাত্তরের চেতনার বাংলাদেশকে আমরা ফিরিয়ে আনব।”

সিপিবি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অশোক সাহা বলেন, “ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করার সুযোগ দিল জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দর্শনে আজও দেশ চলছে। এ থেকে বের হওয়ার সাহস কারও হল না।

“ধর্মে-ধর্মে বিভেদ লাগিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ানো হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা, নারী বিদ্বেষ, জাতি বিদ্বেষ এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ না হলে এমন ঘটনা আরও ঘটবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার আগে যে রাষ্ট্রনীতি ছিল আমরা সে বাংলাদেশ চাই।”

দক্ষিণ জেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, “অত্যন্ত লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে আজ এখানে দাঁড়াতে হচ্ছে। শিক্ষকরা হলো আমাদের আদর্শ। নারায়ণগঞ্জ, নড়াইল, সাভাবে আমাদের নেতাকর্মীরা কী করছিল?”

গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের সমন্বয়ক শরীফ চৌহান বলেন, “ধারাবাহিকভাবে বেছে বেছে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের হত্যা ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষক লাঞ্ছনার যে ঘটনা, তার দায় সরকার এড়াতে পারে না।”

কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, “রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পর থেকে বাকিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এরপর থেকে সেই ধারা আর থামেনি। মূল কথা, রাষ্ট্র-রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিযুক্ত করতে হবে।”

প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, “যখন সাম্প্রদায়িক শক্তির বিচরণ অবাধ করা হল, পাঠ্যক্রম তাদের কথায় বদলানো হল, আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত করা হল, তখন এমনটাই স্বাভাবিক।

“শিক্ষককে নয়, বরং পুলিশ তাদের পাহারা দিয়েছে, যারা তার গলায় জুতার মালা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজও নীরব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারও কাছ থেকে আজ পর্যন্ত কোনো বক্তব্য পাইনি। সবাই তাকিয়ে থাকে একজনের দিকে। তিনি কী বলবেন তারপর ঠিক করে বাকিরা বলবেন।”

শিক্ষক নেতা অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর বলেন, “সবাই এমন ভাব করছে, যেন কিছু ঘটেনি। ক্ষমতার ভাগের জন্য সবাই ঘুরছেন, কিন্তু সঠিক পরিস্থিতি কেউ তুলে ধরছে না।

“একজন শিক্ষক খুন হয়ে গেলেন অথচ শিক্ষকদের একটা বিরাট অংশেরও কোনো সাড়া নেই। ঢাবি শিক্ষক সমিতি বিবৃতি দিল ১১ দিন পর। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যদি মনে করেন আপনারা দূরে, বাকিরা নির্যাতিত হচ্ছে তা হলে ভুল করবেন।”

আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী, অধ্যাপক আনোয়ারা আলম, অধ্যাপক কাঞ্চন চক্রবর্তী, চবি নাট্যকল বিভাগের অধ্যাপক অসীম দাশ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী, শিক্ষক শীলা দাশগুপ্ত, চবি নাট্যকলার শিক্ষক মোস্তফা কামাল যাত্রা।

চবি শিক্ষক সমিতির নিন্দা

সাভারের আশুলিয়ার কলেজ শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা এবং অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করার নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

বুধবার বিকালে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক সেলিনা আখতার ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সজীব কুমার ঘোষ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।

উত্ত্যক্তের ঘটনায় শাসন করায় গত শনিবার সাভারে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে (৩৭) স্ট্যাম্প দিয়ে পেটান তারই প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির এক ছাত্র। পরে তার মৃত্যু হয়। উৎপল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।

আর বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য সমালোচনায় থাকা ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে ফেইসবুকে এক ছাত্রের পোস্টকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন ‍কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়।

শিক্ষক সমিতির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা এবং ইউনাইটেড কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পড়ানোর ঘটনা জাতিকে হতবাক করেছে।

“প্রতিটি ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যর্থতা ও দায়িত্বে অবহেলায় বারবার এই অপরাধগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে।”