আরাফের খুনিরা কৃপা পেতে পারে না: আদালত

আদালত কক্ষের পেছন দিকের একটি বেঞ্চে বসে মোবাইল ফোনে ছেলে আবদুর রহমান আরাফের ছবি দেখছিলেন বাবা আবদুল কাইয়ুম; তার চোখ ছিল ভেজা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2022, 12:52 PM
Updated : 18 May 2022, 12:52 PM

দুষ্টুমিভরা সেইসব ছবি দেখাতে দেখাতে তিনি বলছিলেন, দুপুর বেলা বাসায় গেলে আরাফ কীভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকত। জ্বর জ্বর লাগছে বললে ছেলে কীভাবে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে ডাক্তার সেজে বাবাকে পরীক্ষা করত।

আবদুল কাইয়ুমের স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। তার সেই স্বপ্ন মুছে যায় ২০২০ সালের ৬ জুন বিকেলে। বন্দরনগরীর বাকলিয়ায় মিয়াখান নগরে যে ভবনে আবদুল কাইয়ুম ও ফারহানা ইসলাম দম্পতি থাকতেন, সেই ভবনের ছাদে পানির ট্যাংকে ফেলে হত্যা করা হয় দুই বছর বয়সী আরাফকে।

ভবনের দারোয়ান মো. হাসান, তার মা নাজমা বেগম ও মিয়াখান নগরের বাসিন্দা মো. ফরিদ মিলে বাড়ির মালিককে ফাঁসাতে আরাফকে হত্যা করেন বলে উঠে আসে এ মামলার বিচারে। 

তিন আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিন বুধবার ওই রায়ে বলেন, “আরাফের পরিবারের সাথে হত্যাকারীদের কোনো বিরোধ ছিল না। এই দম্পতির একমাত্র সন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা, এক নির্মম ও জঘন্য হত্যাকাণ্ড।

“এই ঘটনা জানলে যে কোনো পিতামাতাই নিজেদের শিশু সন্তানকে নিয়ে ট্রমাতে ভুগবেন। খেলতে থাকা একটি নিষ্পাপ শিশুকে ঘরের সামনে থেকে যে কেউ ধরে নিয়ে হত্যা করতে পারে, তা তার পিতামাতার ধারণারও বাইরে ছিল।”

বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, “এই হত্যাকারীরা কোনো দয়া-কৃপা পেতে পারে না। সমাজের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হল।”

খুন হতে পারত ‘যে কোনো’ শিশু

একটি বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আবদুল কাইয়ুম ও গৃহিনী ফারহানা ইসলাম দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল আরাফ। ঘটনার দিন বিকালে মিয়াখান নগরে ভবনের সামনে গাড়ি রাখার জায়গায় খেলছিল দুই বছরের শিশুটি।

মায়ের কাছে চানাচুর খাওয়ার পর সে পানি খেতে চেয়েছিল। এ সময় আরাফের মা ফারহানা ইসলাম পানি আনতে ঘরের ভেতরে যান।

তিনি ফিরে এসে দেখেন ছেলে নেই। এ ফাঁকে আদর করার ছলে আরাফকে নিয়ে ভবনের ছাদে চলে যান নাজমা বেগম। সেখানে পানির ট্যাংকে ফেলে আরাফকে হত্যা করা হয়।

মামলা হলে ভবনটির বাসিন্দা নাজমা বেগম, তার ছেলে বাড়ির দারোয়ান হাসান ও তাদের পাশের ভবনের বাসিন্দা ফরিদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

নাজমা বেগম আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘বাড়িওয়ালাকে ফাঁসাতে’ প্রতিবেশীর শিশুকে আদর করার ছলে পানির ট্যাংকে ফেলে হত্যা করেন। তাতে সহায়তা করেন তার ছেলে হাসান।

আটতলা ওই ভবনের মালিক ছিলেন ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আলম মিয়া। তাকে ‘মামলায় ফাঁসানোর জন্য’ ওই ভবনের বাসিন্দা কোনো শিশুকে হত্যা করতে নাজমাকে ২০ হাজার টাকার লোভ দেখিয়েছিলেন পাশের বাড়ির ফরিদ।

নুরুল আলম মিয়ার ভাই ইয়াছিন চৌধুরী আশু বিএনপির সমর্থন নিয়ে ওই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। ফরিদ ছিলেন তারই অনুসারী। তাছাড়া নুরুল আলম মিয়ার প্রচারে হামলার ঘটনায় ফরিদকেও আসামি করা হয়েছিল, সে কারণে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন।

আর ঋণগ্রস্ত হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নাজমা টাকার জন্য ফরিদের ওই প্রলোভনে সাড়া দেন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।

বুধবার রায় ঘোষণার আগে বিচারক আদালতে দেওয়া আসামিদের জবানবন্দি এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে উদ্ধৃত করে আরাফ হত্যার ঘটনাক্রম তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, আসামি হাসান সেদিন বিকাল ৪টার দিকে মায়ের কথা মত ছাদের তালা খুলে দেয়। এরপর নিচে নেমে কোনো বাচ্চা না পেয়ে দোকানে যান নাজমা।

“পরে আবার এসে শিশু খুঁজতে থাকে। যখনই আরাফের মা পানি আনতে ঘরের ভিতরে যান, তখনই আরাফকে কোলে নিয়ে ছাদে চলে যান নাজমা। সেখানে পানির ট্যাংকে ফেলে আরাফকে হত্যা করেন তিনি। আরাফকে নিয়ে যাওয়ার সময় হাসান ভবনের নিচে গেটের কাছে দাঁড়ানো ছিলেন।”

এ মামলার দুজন সাক্ষীও সেদিন বিকালে আরাফকে কোলে নিয়ে নাজমাকে ভবনের ছাদে উঠতে দেখেছিলেন।

রায় ঘোষণার সময় বিচারক বলেন, “এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ফরিদ। নুরুল আলম মিয়ার কারণে কারারুদ্ধ হওয়ায় সে ক্ষিপ্ত ছিল। তার জিঘাংসা চরিতার্থ করতেই নাজমা ও হাসানকে ব্যবহার করে। ঘটনাস্থলে না থাকলেও এই হত্যাকাণ্ডে ফরিদের দায় সর্বাগ্রে।

“যে কোনো একটি বাচ্চাকে ছাদে পানির ট্যাংকে ফেলে হত্যা করে নুরুল আলম মিয়াকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করা হয়। যার ভিকটিম হয় আরাফ।”

রায় ঘোষণার পর আদালতের এপিপি প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটি নিষ্পাপ শিশু ও তার পিতামাতার সাথে কোনো শত্রুতা আসামিদের ছিল না। শুধু একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে ঘায়েল করার জন্য এই হত্যাকাণ্ড।”

তিনি বলেন, “আমার-আপনার সন্তানও তো বাইরে যাচ্ছে। একটি ছোট শিশুকে ঘরের সামনে থেকে নিয়ে হত্যা অকল্পনীয়।”

রায়ের পর আরাফের বাবা আবদুল কাইয়ুম বলেন, “এই রায় একটা দৃষ্টান্ত। দ্রুত রায় কার্যকর হোক, তাই চাই। আর কোনো মা-বাবার সন্তান যেন এভাবে না হারায়।”

আরও খবর