হালদায় হতাশা: ডিম ছাড়ায় 'ভাটা' যে কারণে

ভরা পূর্ণিমায় নদীতে মা মাছের আনাগোনা থাকলেও ডিম ছাড়ার উপযোগী বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল নামেনি; যে কারণে মেলেনি প্রত্যাশিত ডিমও।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2022, 05:24 PM
Updated : 16 May 2022, 06:27 PM

এবার সোমবার ভোরে জোয়ারের সময় ডিম ছাড়ে মা মাছ। দুপুরে আবারও জোয়ার এলে ডিম ছাড়ে মাছেরা। নদীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডিম সংগ্রহকারীরা দিনভর প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন সেগুলো সংগ্রহে।

তবে দিন শেষে হতাশ হয়েই তাদের ফিরতে হয়েছে। যদিও তারা একেবারে হাল না ছেড়ে আশা করছেন, আগামী অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় হয়ত আবার ডিম ছাড়তে পারে মা মাছ।

হালদা পাড়ের হাটহাজারী মধ্যম মাদার্শার বাসিন্দা আশু বড়ুয়া নব্বইয়ের দশক থেকে ডিম সংগ্রহ করেন। এবার তার ছয়টি নৌকায় সব মিলে ডিম পেয়েছেন তিন বালতির মত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এবার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। গত কয়েকদিন ধরে নদীতে ছিলাম। গতকাল (রোববার) রাতে বজ্রসহ বৃষ্টি হয়েছিল। এরপর ভোরে মা মাছ ডিম ছাড়ে অল্প পরিমাণে।

“ভাটার টানে ডিম সরে যায়। নতুন খালের মুখ, নাপিতের ঘোনা, আমতুয়া ও ছায়ার চরের দিকে কিছু ডিম পাওয়া গেছে।”

অভিজ্ঞ এ ডিম সংগ্রহকারী বলেন, “নদীতে মা মাছের আনাগোনা আছে। আশাকরি আগামী অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় আবার ডিম ছাড়বে। তখন যদি কিছু ‍ডিম পাওয়া যায়।”

নদীর বিভিন্ন অংশে এবার আটটি নৌকায় ডিম সংগ্রহে নামেন বর্ষীয়ান সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর। তিনি বলেন, “সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা নৌকা নিয়ে নদীতে ছিলাম। নৌকা প্রতি এক বালতির মত ডিম পাওয়া গেছে। এতে খরচও উঠবে না।“

বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল না থাকায় এবার ডিম পাওয়া যায়নি, বলে ভাষ্য তার।

তার মত প্রায় ৬৫০ জন ডিম সংগ্রহকারী সোমবার ভোর থেকে ৩১৫টি নৌকা নিয়ে নদীর হাটহাজারী ও রাউজান অংশের আজিমের ঘাট, অংকুরি ঘোনা, ছায়ার চর, কাগতিয়ার মুখ, গড়দুয়ারা, নয়াহাট, রাম দাশ মুন্সির ঘাট, মাছুয়া ঘোনা ও সত্তার ঘাট অংশে ছিলেন।

প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিম না পাওয়ায় যাদের বেশির ভাগই হয়েছেন হতাশ।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে সোমবার ভোরে বৈশাখী পূর্ণিমার জোয়ারের সময়ে হালদায় ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ।

এবার পূর্ণিমার তিথি শুরু হয়েছিল রোববার বেলা ১২টা ২১ মিনিটে, যা ছিল সোমবার বেলা ১২টা ২৮ মিনিট পর্যন্ত।

তবে এসময় ডিম ছাড়ার উপযোগী যতটুকু পাহাড়ি ঢল বা বৃষ্টি আশা করেছিলেন সংগ্রহকারীরা তা ছিল না।

একই কারণ তুলে ধরেছেন হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এবারের পরিস্থিতি হতাশাজনক। দূষণ কমাতে দূষণকারী কারখানা ও তামাক চাষ বন্ধ হয়েছে। মা মাছ রক্ষায় নৌ পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন সারাবছর অভিযান করেছে।

“নদীতে মাছের আনাগোনাও ছিল পর্যাপ্ত সংখ্যায়। ডিম ছাড়তে মাছ প্রস্তুত ছিল। পূর্ণিমার সময় আজ জোয়ারের উচ্চতা বাড়ায় কিছু ডিম ছেড়েছে। কিন্তু ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল কোনোটাই না থাকায় পানির তাপমাত্রা অনুকূলে ছিল না। সংগ্রহ করা ডিমের পরিমাণ ৩ হাজার কেজির মত।”

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল না থাকায় কয়েক দফায় অল্প অল্প করে ডিম ছেড়েছে মাছ। র‌্যানডম স্যাম্পলিং করে যে প্রাথমিক হিসাব করা হয়েছে তাতে তিন হাজার কেজির মত ডিম সংগ্রহ হয়েছে।

“ব্যক্তিগত মাটির কুয়াতেও কিছু ডিম আছে। সন্ধ্যার পরও কিছু ডিম সংগ্রহ হয়েছে বলে শুনেছি। আজ রাতেও ডিম সংগ্রহকারী নদীতে থাকবেন। চূড়ান্ত হিসাব করে বলা যাবে মোট কত ডিম পাওয়া গেছে।”

২০২১ সালেও হালদায় দুই দফায় মোট আট হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল বলে জানান তিনি।

এর আগের বছর ২০২০ সালে ২২ মে ডিম ছেড়েছিল মা মাছ। সেসময় আনুমানিক সাড়ে ২৫ হাজার কেজির বেশি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল, যা ছিল ২০০৬ সালের পর সর্বোচ্চ।

হালদা যেখানে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে, সেই কালুরঘাট সেতুর কাছের অংশ থেকে উজানে মদুনাঘাট হয়ে নাজিরহাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার অংশে নদীর দুই তীরে তিন উপজেলা হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি।

এর মধ্যে মদুনাঘাট থেকে সমিতির হাট পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশে হাটাহাজারী ও রাউজান উপজেলা সংলগ্ন অংশেই মেলে নিষিক্ত ডিম।