রেলের জায়গা নিয়ে ‘বিরোধে’ ‘পরিচিতদের’ হাতেই খুন ফরিদ

চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে পিটুনিতে নিহত মোটর মেকানিকের মৃত্যুর পেছনে রেলের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে দোকান ও ঘর ভাড়া দেওয়াসহ স্থানীয় ‘পরিচিতদের’ সঙ্গে আগের ‘বিরোধই’ কাজ করছে বলে পুলিশ ও স্থানীয়দের ভাষ্য।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2022, 06:06 PM
Updated : 9 May 2022, 09:41 AM

পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগ, রেলের জায়গা ‘বরাদ্দ নিয়ে’ সেখানে দোকান ও ঘর নির্মাণ করায় নিহত মো. ফরিদ (৪৫) এর কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি। টাকা না দেওয়ায় এবং আদালতে মামলা করতে চাওয়ায় তাকে পিটিয়ে খুন করা হয়।

শনিবার রাতে পাহাড়তলী রেলওয়ে স্টেশন জামে মসজিদের কাছে এলাকায় মোটর মেকানিক হিসেবে পরিচিত ফরিদকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। পরে ভোররাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

রোববার রাত ১১টা পর্যন্ত এ ঘটনায় মামলা হয়নি এবং পুলিশ কারও গ্রেপ্তারের খবর দেয়নি।

নগর পুলিশের উপ কমিশনার (পশ্চিম) আব্দুল ওয়ারীশ বলেন, “প্রাথমিকভাবে এলাকার আধিপত্য বিস্তার ও শত্রুতার জেরে ফরিদকে খুন করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তার পাশাপাশি আমরা রেলের জায়গা দখলসহ বিভিন্ন বিষয় শুনছি।

“সব বিষয় মাথায় নিয়ে আমরা তদন্ত করছি।”

নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (ডবলমুরিং জোন) আরিফ হোসেন সকালে জানিয়েছিলেন, “গাড়ি ওয়াশের জন্য রেলওয়ে কলোনিতে একটি স্থাপনা তৈরি করেছিলেন ফরিদ। স্থানীয় কিছু লোক তার কাছে চাঁদা দাবি করে ।

“ফরিদ চাঁদা না দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেয়। সেজন্য শনিবার রাত সোয়া ১১টার দিকে ৮/১০ লোক গিয়ে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে তাকে গুরুতর জখম করে।“

এদিকে নিহত ফরিদ এবং তার উপর হামলকারীরা সবাই স্থানীয় বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত বলে পুলিশকে জানিয়েছে স্থানীয় লোকজন।

স্থানীয়রা জানান, ফরিদ এবং তাকে পেটানো ব্যক্তিরা এক সময় একপক্ষেই ছিলেন। পাহাড়তলী এলাকার সাবেক এক জনপ্রতিনিধির হয়ে কাজ করতেন তারা। তবে তিন বছর আগে ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন সোহেল হত্যাকাণ্ডের পর তার সহযোগী অনেকেই আসামি হয়ে ‘কোণঠাসা’ হয়ে পড়ে।

সম্প্রতি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেলের নিয়ন্ত্রণে থাকা কিছু জায়গা ফরিদ দখলে নিয়ে দোকান ও ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিলে তাদের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়তে থাকে।

শনিবার রাতে ফরিদের উপর হামলার সময় তার সঙ্গে ছিলেন আলমগীর মানিক নামে তার এক বন্ধু।

সকালে চমেক হাসপাতাল মর্গে মানিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে পাহাড়তলী স্টেশন জামে মসজিদের সামনে একটি দোকানে তিনি ও ফরিদ গল্প করছিলেন। এসময় সেখানে আলাউদ্দিন আলো, মনা, দিদারুল আলম ওরফে টেডি দিদার, ফেরদৌসসহ ২০/২৫ যুবক গিয়ে ফরিদের ওপর হামলা করে।“

তার অভিযোগ, “রেলের জায়গায় ঘর ও দোকান নির্মাণ করায় আলাউদ্দিন আলো দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ফরিদের কাছ থেকে। টাকা না পেয়ে পরিকল্পিতভাবে ফরিদকে পিটিয়ে খুন করা হয়।”

মানিক বলেন, “চাঁদা দাবির অভিযোগে ফরিদের সঙ্গে আমিও তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে গিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে। আমাদের উকিল বলেছিল আজকে (রোববার) যেতে। আজকে আমাদের আদালতে যাবার কথা ছিল আলোদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। তার আগেই ফরিদকে খুন করা হল।“

মানিকের দাবি, এসময় তাকেও মারধর করে হামলাকারীরা। তখন একজন ছেড়ে দিতে বললে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর তিনি কিছুদূর গিয়ে পুনরায় ফিরে এসে ফরিদকে না মারার জন্য মনা নামে একজনকে অনুরোধও করেন। আবারও তাকে ‘ঘুসি মেরে’ সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় বলে দাবি করেন তিনি। 

ফরিদের স্ত্রী নাহিদা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ফরিদের খালু রেলওয়েতে চাকরি করতেন। তার কোয়ার্টারের পাশে কিছু খালি জায়গায় ফরিদ দোকান ও ঘর নির্মাণ করেছিলেন। পাশাপাশি নিজের জন্য গাড়ি সার্ভিসিংয়েরও একটি দোকান নির্মাণ করেন রোজার আগে।

“এসময় আলাউদ্দিন আলো, চশমা ফারুক, দেলোয়ার নামে কয়েক জন তার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করেন। আট রোজার দিন সোহেল নামে স্থানীয় এক যুবক আরও কয়েকজন মিলে ফরিদকে কুপিয়ে জখম করে। এসময় ফরিদ তিন দিন হাসপাতালে ছিলেন এবং দুই হাতে ১৩টি সেলাই দিতে হয়েছে।”

পেটানোর পর রিকশায় তুলে দেয় হামলাকারীরা 

রাতে ফরিদের ওপর হামলার খবর শুনে স্টেশন জামে মসজিদের সামনে যান ফরিদের স্ত্রী নাহিদা।

তিনি বলেন, “আমি গিয়ে দেখি ফরিদ হাঁটু গেড়ে বসে আছে। এসময় আমি গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরি। তখন তারা (হামলাকারীরা) আমাকে বলে তোর জন্য ফরিদকে ছেড়ে দিলাম। এসময় আলো বলতে থাকে ‘তোরা টাকা রোজগার করবি, আমরা করতে না পারলে তোকে ও মনছুরকে মেরে ফেলব’।“

মনছুর তার ননদের স্বামী বলে পরিচয় দেন নাহিদা।

নাহিদা জানান, এরপর হামলাকারীরাই ফরিদকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য একটি রিকশায় তুলে দেয়।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটর মেকানিক পরিচয় দিলেও ফরিদ এলাকায় জায়গা দখলসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে দুটি মামলাও আছে। এসব মামলায় বেশ কিছুদিন কারাগারেও ছিলেন তিনি।

আগের ঘটনার পূর্বাপর

একসময় পাহাড়তলী বাজার, রেল স্টেশনসহ আশেপাশের এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করত মনসুর, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাবের আহম্মেদ ও নিহত ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন সোহেল। ফরিদ ছিলেন মনসুরের পক্ষের লোক।

২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজারে মহিউদ্দিন সোহেলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ ও ব্যবসায়ীরা সে সময় বলেছিলেন, বাজারের লোকজন ‘চাঁদাবাজি’তে অতিষ্ট হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

কিন্তু পরিবারের দাবি মহিউদ্দিনকে ‘পরিকল্পিতভাবে’ পিটিয়ে খুন করা হয়।

এ ঘটনায় সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাবের আহম্মেদসহ ৫২ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। ফরিদের উপর হামালকারী হিসেবে নাম আসা মনা, দিদারুল আলম ওরফে টেডি দিদার, ফেরদৌসও আসামি আছেন মহিউদ্দিন হত্যা মামলায়।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় ফরিদের বাড়ি হলেও তিনি থাকতেন পাহাড়তলী এলাকায় তার খালুর বাসায়। সেখানে খালি জায়গায়ে দোকান ও ঘর নির্মাণ করেন ফরিদ। পরে সেগুলো তার কাছ থেকে দখলে নেয় নিহত ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন। ২০১৯ সালে মহিউদ্দিন নিহত হওয়ার পর জায়গাগুলো খালি পড়ে ছিল।

তবে মাসখানেক আগে সেসব জায়গায় ফরিদ দোকান ও ঘর নির্মাণ করেন। যেখান থেকেই মূলত আলাউদ্দিন আলো ও ফরিদের সাথে দূরত্বের সৃষ্টি হয়।