লাখ লাখ মিটার জাল জব্দ হচ্ছে; আটক হচ্ছে নৌযান। এমনকি বড়শিও জব্দ করছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু শিকারীরা ক্ষান্ত হচ্ছে না।
শুধু জেলেরাই হালদায় জাল পাতে এমন নয়। অন্য পেশার লোকজনও বাড়তি আয়ের জন্য মাছ শিকার করে। এমনকি স্থানীয় অবস্থাসম্পন্নরাও ‘বিনিয়োগ’ করেন হালদায় মাছ শিকারের পেছনে।
হালদা পাড়ের মানুষসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাছ শিকার থামানো যাচ্ছে না কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে আছে- নদী তীরের মানুষের সচেতনতার অভাব, মাছ শিকারের ‘লোভ’ এবং হালদা তীরের মৎস্যজীবীদের কোনো বিকল্প জীবিকা না থাকা।
হালদায় মৌসুমের প্রথম দিকের বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল নামলে উপযুক্ত পরিবেশে ডিম ছাড়ে মা মাছ। তখন ডিম সংগ্রহকারীরা নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেন।
ওই সময় হালদায় ডিম ছাড়তে নদী ও সংযুক্ত খালগুলোর মা মাছেরা জড়ো হয়। এমনকি সংযুক্ত অন্য নদী থেকেও মা মাছেরা আসে বলে ধারণা করা হয়।
নদীতে মা মাছের আনাগোনা বাড়ার সাথে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় চোরা শিকারীদের তৎপরতা। এপ্রিল-জুন পর্যন্ত প্রজনন মৌসুম। এছাড়া সারা বছরই গোপনে মাছ ধরা চলে। রুই, কাতাল, কালবাউশ ছাড়াও জালে ধরা পড়ে চিংড়ি, আইড়, বোয়ালসহ নানা জাতের মাছ।
মাছ শিকারীদের তৎপরতা বন্ধে নদীতে অভিযান চালায় স্থানীয় প্রশাসন, নৌ পুলিশ ও মৎস্য বিভাগ।
তিনি জানান, এসব অভিযানে ১ লাখ ১০ হাজার মিটার জাল এবং জাল বসানোর কাজে ব্যবহৃত ১১টি নৌকা ধ্বংস করা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে মোট ৬০ হাজার টাকা। একজনকে ১৫ দিনের কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।
শাহিদুল আলম বলেন, “আমরা যত জাল উদ্ধার করি, সব ধ্বংস করা হয়। গত ২-৩ মাস ধরে জালের পরিমাণ কমে এসেছে, বিশেষ করে গড়দুয়ারা, গুমানমর্দন, ফরহাদাবাদ এলাকায়। আগে যেখানে ৮-৯ মিটার জাল জব্দ করা হত, এখন সেখানে ২ হাজার মিটার পাচ্ছি। ধারণা করি ৪-৫ মাসের মধ্যে একেবারে কমে আসবে।”
এর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হাটহাজারীর ইউএনও পদে ছিলেন মো. রুহুল আমিন। সে সময় হালদায় ১৭৮টি অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩ লাখ ৩ হাজার ৪০০ মিটার ঘেরা জাল জব্দ করা হয়।
নৌ পুলিশ ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৬২০ মিটার জাল জব্দ করেছে। এই সময়ে ১০২টি অভিযান চালানো হয়। মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইনে তিনটি মামলাও হয়।
তবে এসব অভিযানের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে হালদা রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসা স্থানীয় বাসিন্দা আমিনুল ইসলামের।
তিনি বলেন, “যত জাল জব্দ হয়, তার সব কী ধ্বংস করা হয়? কারণ যে পরিমাণ জালের কথা বলা হচ্ছে, তত জাল দুই উপজেলায় থাকার কথা নয়। অত জেলেও তো এখন নেই হালদা পাড়ে।”
তিন জাল, অমাব্যসা-পূর্ণিমার অপেক্ষা
হালদায় মাছ শিকারে ব্যবহার করায় হয়- ভাসা জাল, ঘেরা জাল ও বেহুন্দি জাল।
নৌ পুলিশের ওসি এবিএম মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চরঘেরা জাল বসানো হয় নদীর এক তীর ঘিরে। ভাসা জালে শোলা লাগানো থাকে। আর বেহুন্দি জাল বসানো হয় ‘ফিক্সড ইঞ্জিন’ দিয়ে। রাতেই বেশিরভাগ জাল পাতা হয়।
হালদা পাড়ের জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, তাদের সহয়তা করার পাশাপাশি রেনু থেকে পোনা উৎপাদনের একটি হ্যাচারি চালায় বেসরকারি সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ)।
সাম্প্রতিক দিনগুলোর পর্যব্ষেণ তুলে ধরে আইডিএফ এর প্রজেক্ট ম্যানেজার মাহমুদুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দিনের বেলা এখন মাছ শিকার হয় না। রাতের বেলাতেই বেশিরভাগ শিকার করে। শেষ চার-পাঁচটা অভিযানে দিনের বেলা আমরা কোনো জাল পাইনি। ভোরের অভিযানে পেয়েছি।”
শিকারী কারা
হালদা পাড়ের বর্ষীয়ান মৎস্যজীবী কামাল সওদাগর মৌসুমে ডিম সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত। নদীতে অবৈধভাবে মাছ শিকার বন্ধেও তিনি সক্রিয়।
একদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, “একদিন মোহনার কাছে একটা জাল আটকেছি। নৌকায় থাকা লোকটি তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো, তার স্ত্রীর অপারেশন হয়েছে। ঘরে খাবার মত কিছু নেই। জাল দিয়ে মাছ পেলে বিক্রি করে খাবার নেবে।”
কামাল সওদাগরের ভাষায়, “হালদায় কেউ অভাবে জাল মারে। আর কেউ শখে মাছ মারে, বড়শি বায়। যারা নদীর উপর নির্ভরশীল, তারা মাছ না মারলে কীভাবে চলবে? তাদের কান্না তো কেউ বুঝতে চায় না। হালদা পাড়ের মানুষ অসহায় হয়ে জাল দেয়।”
“হালদা থেকে শিকার করা এসব মাছ নগরীর বিভিন্ন বড় বাজারে চলে যায়। এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থানে চড়া দামে বিক্রি হয়।”
আর নৌপুলিশের কর্মকর্তা এবিএম মিজানুর রহমান বলেন, হালদায় যারা মাছ ধরে, তাদের সবাই যে জেলে এমন নয়। অন্য পেশার লোকদেরও তিনি পেয়েছেন, যারা সুযোগ পেয়ে মাছ শিকার করে। বিক্রি করলে বাড়তি আয় হয়।
“একটা চরঘেরা জালের দাম ৩০-৪০ হাজার টাকা প্রায়। একেকটা বেহুন্দি জাল ৫০-৬০ হাজার টাকা। দরিদ্র জেলেদের পক্ষে এ জাল বসানো সম্ভব না। স্থানীয় অবস্থাসম্পন্নরা এতে বিনিয়োগ করে। আবার নদী পাড়ের কিছু মানুষ জাল দেওয়াকে খারাপ কিছু মনে করে না।”
একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেল আইডিএফ এর প্রজেক্ট ম্যানেজার মাহমুদুলের কথায়।
“সচেতন লোকজন যেমন আছে, তেমনি একশ্রেণির মানুষ আছে যাদের ধারণা- হালদার মাছ খেতে হবে। কেউ কেউ মাছের নেশায়ও শিকার করে। তারা এটা স্বাভাবিক মনে করে। আবার ব্যবসার কারণে অনেকে লোক লাগিয়ে মাছ শিকার করায়।”
হাটহাজারী উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল হুদা রনিও বললেন, মাছ শিকারী সবাই প্রকৃত জেলে না।
“মাছের নেশা, নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ, বাজারে বিক্রির জন্যও কেউ কেউ ধরে। সবসময় তো অভিযান করা সম্ভব হয় না। অনেক জাল আমরা উদ্ধার করি। তারপরও আবার জাল দেয়।”
ভরসা তিন স্পিড বোট
হালদা যেখানে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে, সেই কালুরঘাট সেতুর কাছের অংশ থেকে উজানে মদুনাঘাট হয়ে নাজিরহাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার অংশে নদীর দুই তীরে হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি এই তিন উপজেলা।
কালুরঘাট থেকে সমিতির হাট পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশ ঘিরেই প্রজনন মৌসুমে চলে চোরা শিকারীদের উৎপাত।
নদীর এই পুরো অংশে অভিযান পরিচালনা করতে ভরসা নৌপুলিশের দুটি এবং আইডিএফ এর একটি স্পিড বোট।
ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “হালদা-কর্ণফুলীর মোহনা অরক্ষিত ছিল এতদিন। এখন নৌপুলিশ ওই এলাকায় টানা অভিযান চালাচ্ছে। এতে প্রচুর জাল উদ্ধার হচ্ছে। জাল পাতাও কমেছে।
“কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন আইডিএফ এর স্পিডবোট নিয়ে অভিযানে যায়। তাদের নিজস্ব কোনো জলযান নেই।”
ইউএনও থাকাকালে হালদায় শতাধিক অভিযান পরিচালনাকারী মো. রুহুল আমিন মনে করেন, হালদা পাড়ের মানুষের সচেতনতা ছাড়া শুধু অভিযানে মাছ শিকার বন্ধ করা সম্ভব নয়।
“হালদায় এত অভিযানের পরেও পুরো সুফল পাচ্ছি না, কারণ হালদার দুই পাড়ের মানুষকে এখনো পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে পারিনি। হালদা পাড়ের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
“কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, মা মাছ শিকার ও বালু উত্তোলন বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষের আপত্তি নেই। সচেতন মানুষ শতকরা ১০ ভাগ হবে।”
চাই বিকল্প জীবিকা
মৎস্যজীবী কামাল সওদাগর বলেন, সাগরেও মাছ ধরা বন্ধ থাকলে চাল-ডাল দেওয়া হয়। তাতে জাটকা ধরা বন্ধে সরকার অনেকটা সফল হতে পেরেছে। কিন্তু হালদার ওপর যাদের জীবন চলে, তাদের জন্য কোনো সরকারি বরাদ্দ নেই।
তবে চাল-ডাল দিয়ে জেলেদের খুব বেশি সহযোগিতা যে করা যাবে না, সে কথা তুলে ধরে আইডিএফ এর মাহমুদুল হাসান বলেন, কৃষি বা মাছ চাষের মত অন্য কোনো কাজে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
“সবাই অভিযান করছে, কিন্তু বিকল্প জীবিকার কোনো ব্যবস্থা তো কেউ করছে না। তাই একটা ক্ষোভও আছে স্থানীয়দের। সরকারের উচিত বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া।”
এ সংস্থার হিসাবে, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলায় হালদার দুই তীরে ২৫০০ জন মৎস্যজীবী এবং ৬০০ ডিম সংগ্রহকারী হালদার উপর নির্ভরশীল।
২০০৭-২০১৩ পর্যন্ত হালদা পুনরুদ্ধার প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প চালু ছিল। তখন হালদা তীরের জেলেদের বিকল্প জীবিকার জন্য ঋণ দেওয়া হত বলে জানান হাটহাজারী উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল হুদা রনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এখন যাতে প্রকৃত জেলেদের জীবিকার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা যায়, সেজন্য জেলা প্রশাসনের সভায় তারা প্রস্তাব দিয়েছেন।
হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হলেও সামগ্রিক কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি জানিয়ে ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নদী তীরের জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। তারা জানে জাল দিলে মাছ মিলবে। তাদের জীবন জীবিকা হালদা নির্ভর। তাদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।”
মাছ শিকার বন্ধে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে মন্তব্য করে মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “বাইরে থেকে গিয়ে কেউ এটা বন্ধ করতে পারবে না।”
এ বিষয়ে হালদা পাড়ের মানুষ অত সচেতন নয় মন্তব্য করে স্থানীয় বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, “কিছু এনজিও অল্প মানুষকে সচেতন করতে পেরেছে। সেটা কয়েকটি এলাকায়। পুরো হালদা পাড়ের মানুষকে সচেতন করা সম্ভব হয়নি। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে যদি কার্যক্রম নেওয়া যেত, তাহলে সচেতনতা বাড়ত।”