অদম্য লড়াকু রায়হান এবার একটি চাকরি চান

শুধু কনুই পর্যন্ত একটি হাতকে সঙ্গী করে স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়েছেন চট্টগ্রামের বাহার উদ্দিন রায়হান; মাকে ভালো রাখতে এবার তিনি একটি চাকরি চান।

আজহারুল ইসলাম জুয়েল, চবি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2022, 12:10 PM
Updated : 5 May 2022, 12:10 PM

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার থেকে বিদ্যুতে ঝলসে রয়হানের এই দুর্গতি। তবে তিনি থেমে থাকেননি।

কারো সাহয্য ছাড়াই নিত্যদিনের সব কাজ করতে পারেন এই তরুণ। কলম মুখে আটকে কনুইয়ের সাহায্যে তিনি লেখেন, একইভাবে কম্পিউটারে কম্পোজ করেন।

হাত ও মুখ দিয়ে লিখেই চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৩.৮১ জিপিএ নিয়ে এসএসসসি এবং চকরিয়া কলেজ থেকে ২.৩৩ জিপিএ নিয়ে এইচএসসি পাস করেন রায়হান। দুই পরীক্ষাতেই বিভাগ ছিল বাণিজ্য।

এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ২.৭৫ সিজিপিএ নিয়ে রায়হানের স্নাতক পাস করা শ্রুতিলেখকের সাহায্য নিয়ে। এখন মাস্টার্স করার পাশাপাশি সংসারে মাকে খানিকটা স্বস্তি দিয়ে চান তিনি, আর সেজন্য যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি পাওয়ার আশায় রয়েছেন তিনি। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রায়হান বলেন, “নিজের চেষ্টায় এতটুকু পর্যন্ত এসেছি। এখন নিজের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া এবং মাকে সহযোগিতা করার জন্য একটা চাকরির খুব দরকার।

“অনার্স শেষ। এখন তো বাড়িতে মাকে খরচ না দিয়ে পারবো না। উনার চিকিৎসা, ওষুধপত্রসহ অনেক খরচ আছে। আমি যতটুকু সক্ষম, আমার যোগ্যতা অনুযায়ী কেউ যদি আমাকে একটা চাকরি দেয়, আমার খুব উপকার হবে।"

চাকরি করে ভাগ্য পরিবর্তনের আশার কথা জানিয়ে সম্প্রতি ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন রায়হান। 

এতদিন তিনি নিজের খরচ যুগিয়েছেন পড়াশোনার পাশাপাশি ভ্রমণ বিষয়ক একটি ওয়েবসাইট চালিয়ে, যেটি তিনি খুলেছিলেন এক বন্ধুর সহায়তায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০১৬-১৭ সেশনে ভর্তি হয়ে জমানো টাকা দিয়ে কিনে ফেলেন একটি কম্পউটার। এর আগে কলেজে পড়ার সময় হাঙ্গার প্রজেক্টের আওতায় 'অ্যাকটিভ সিটিজেন ইয়ুথ লিডারশিপ' প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, সেই অভিজ্ঞতায় বাড়িতেই একটি 'প্রশিক্ষণ কেন্দ্র' চালু করেন।

রায়হান বলেন, “২০১৫ সালে ডেভেলপার দিয়ে ভ্রমণ বিষয়ক ওয়েবসাইট 'কেমনে যাব ডট কম' বানিয়েছিলাম। এরপর থেকে নিজেই পরিচালনা করছি। দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে যাতায়াতের জন্য দূরপাল্লার পরিবহনের তথ্য আছে ওয়েবসাইটে।”

এই ওয়েবসাইটে পাওয়া বিজ্ঞাপন থেকে মাসে তিন/চার হাজার টাকায় চট্টগ্রাম শহরে থেকে টেনেটুনে নিজের খরচ চালিয়েছেন রায়হান। অন্যদিকে কক্সবাজারের চকরিয়ায় থাকা তার মা চলেন অন্যের জমিতে কাজ করে।

রায়হান বলেন, “এখন আমি স্নাতক পাশ। মাকে তো অন্যের জমিতে কাজ করতে দিতে পারি না। তাই একটা চাকরি খুব দরকার।”

রায়হান জানান, কম্পিউটারের বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা আছে তার। ইউটিউবে তার ‘বাহার রায়হান’ নামে নিজস্ব চ্যানেল আছে।

এনজিও বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বা প্রশাসনিক বিভাগে অথবা প্রশিক্ষণ খাতেও কাজ করতে পারবেন বলে তিনি আত্মবিশ্বাসী।

ছোটবেলার সেই দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করে রায়হান বলেন, বাড়ির পাশে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারে একটি ছোট পাখি ঢুকে পড়েছিল। তখন তিনি পড়েন পঞ্চম শ্রেণিতে। কৌতুহল নিয়ে সেই খুঁটিতে উঠে বৈদ্যুতিক তারে হাত দিতেই ঝলসে যায় তার দুই হাত, বুক এবং পায়ের কিছু অংশ। এরপর চিকিৎসা চলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

পাঁচ দিনের মাথায় তার এক হাত এবং আরেক হাত কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়। তারপরও জীবন শঙ্কা কাটতে দীর্ঘ সময়ে লেগেছিল।

রায়হান যখন ছোট, সংসার ফেলে নিরুদ্দেশ হন তার বাবা। হাসপাতালে যখন ছিলেন, তখন চিকিৎসার খরচ দিতে মামারা। তার এ পর্যায় পর্যন্ত আসতে মামা এবং নানাবাড়ির লোকজনদের অবদানই সবচেয়ে বেশি।

রায়হান বলেন, হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর খালাতো বোন মুসলিমার পরামর্শেই তিনি মুখে বা পায়ের সাহায্যে লেখার চেষ্টা শুরু করেন। আর সেই চেষ্টাই তাকে স্নাতক করেছে।

ছোটবেলা থেকেই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখার কথা জানিয়ে রায়হান বলেন, “অনাথ, দরিদ্র ও স্কুলবিমুখ বাচ্চাদের নিয়ে আমি কাজও করেছি। এ পর্যন্ত ৫০ জন স্কুলবিমুখ শিশুকে তাদের বাবা-মার সাথে কাউন্সেলিং করে স্কুলে পাঠিয়েছি।”

সুযোগ পেলে স্থায়ী কিছু করার পরিকল্পনা আছে জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী যদি একটা কাজ পাই, তাহলে সেবামূলক কাজের পরিধি বাড়ানো যাবে বলে আশা রাখি।”