‘বাংলার সমৃদ্ধি’র ভবিষ্যৎ কী?

ইউক্রেইনে যুদ্ধের মধ্যে গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’কে মেরামত করে পুনরায় সচল করা কিংবা বীমা কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ আদায় করা, এই দুই বিকল্প এখন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) সামনে।

মিন্টু চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2022, 06:33 PM
Updated : 7 March 2022, 06:33 PM

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধকালীন অনিশ্চিত অবস্থায় মেরামতের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে বীমা কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ আদায় করে নতুন জাহাজ কেনাই লাভজনক হবে।

কোন পথে যাবে- সে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না করলেও বিএসসি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এরই মধ্যে বীমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। তাদের কাছ থেকে উত্তর পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশের এই জাহাজটি বাংলাদেশের সাধারণ বীমা করপোরেশন এবং যুক্তরাজ্যের ইন্সুরেন্স মার্কেট লয়েড’স অব লন্ডনের বিজলি গ্রুপে বীমা করা আছে বলে বিএসসি কর্মকর্তারা জানান।

বিএসসির এই জাহাজটি ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান ডেলটা করপোরেশনের কাছে ভাড়া দেওয়া ছিল। তাদের পরিচালনায় পণ্য পরিবহনের সময়ই ইউক্রেইনের ওলভিয়া বন্দরে যুদ্ধের মধ্যে পড়ে জাহাজটি।

গোলার আঘাতে জাহাজটির নেভিগেশন ব্রিজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আগুনে অন্যান্য ক্ষতিও হয়েছে। বেঁচে থাকা নাবিকদের সরিয়ে নেওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটি ওলভিয়া বন্দরেই পড়ে আছে।

বিএসসি কর্মকর্তারা জানান, প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে চীন থেকে ২ কোটি ৬৩ লাখ ডলারে কার্গো জাহাজটি কেনা হয়েছিল। অবচয় শেষে জাহাজটির বর্তমান মূল্য দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ ডলার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলার সমৃদ্ধিকে মেরামত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে এর চেয়েও বেশি অর্থ খরচ হতে পারে। যুদ্ধ ঝুঁকির পরিপ্রেক্ষিতে করা ইন্সুরেন্স পলিসির আওতায় বিএসসি বীমা থেকে এ পরিমাণই অর্থই ফেরত পেতে পারে।

মেরিটাইম আইনজীবী ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন আবদুল কাদির বলছেন, “এখন বিএসসির সিদ্ধান্তের বিষয়- জাহাজটি যুদ্ধ শেষে মেরামত করবে, না কি ইন্সুরেন্স থেকে পাওয়া অর্থে নতুন শিপ কিনবে। ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে নোটিস দিলে তারা সেটি পরীক্ষা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।”

যুদ্ধের মধ্যে গোলার আঘাতে জ্বলছে বাংলার সমৃদ্ধি।

বাংলাদেশে জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাজ করে আসা মাস্টার মেরিনার ক্যাপ্টেন মেহেরুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সমুদ্রগামী জাহাজের ক্ষেত্রে সেটির মোট দাম ইন্সুরেন্স হিসেবে বিবেচিত হয়। বিএসসির সকল জাহাজের ওয়ার রিস্ক কাভারেজ রয়েছে। জাহাজটি এখন পরিত্যক্ত। সুতরাং জাহাজটি উদ্ধার না করে ইন্সুরেন্সের টাকা ক্লেইম করাই শ্রেয়।”

বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (চার্টার) ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলার সৃমদ্ধি সম্পূর্ণ ইনসুরেন্স কাভারেজের মধ্য রয়েছে। এটি যুদ্ধ ঝুঁকির বিষয়টি কাভার করবে।”

বাংলাদেশ মেরিটাইম ল সোসাইটির মহাসচিব মহিউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদি যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যায়, তাহলে বিএসসি চাইলে জাহাজটি নিজেদের আওতায় নিয়ে পুনরায় মেরামত করে সচল করতে পারে। এক্ষেত্রে ইন্সুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণের জন্য নোটিস দিয়ে সেটিসহ মেরামতের খরচ চাইতে পারে।”

জাহাজের ক্ষতিপূরণের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার ক্রুদের সঙ্গে যে ধরনের চুক্তি রয়েছে, সেভাবে ইন্সুরেন্স কোম্পানির ক্ষতিপূরণের অর্থও পরিশোধ করার কথা রয়েছে, বলেন ক্যাপ্টেন মেহেরুল।

“মারা যাওয়া ক্রু’র পরিবারও ক্ষতিপূরণের অর্থ পাবেন এর আওতায়।”

মহিউদ্দিনও বলেন, “বিএসসি ইন্সুরারকে নোটিস দিয়ে ক্ষতিপূরণের পুরো অর্থ দাবি করতে পারে। এর সাথে ক্রুদের ক্ষতিপূরণের অর্থও আসবে।”

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠান বিএসসির বীমার দাবিকৃত অর্থ পরিশোধ করলে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের উপর বিএসসির আর কোনো দাবি থাকবে না।

মহিউদ্দিন কাদির বলেন, “পরবর্তীতে এটি ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠানের সম্পদে পরিণত হবে এবং তারাই জাহাজটির বিষয়ে ব্যবস্থা নিবে। স্ক্র্যাপ হিসেবেও ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠান জাহাজটিকে বিক্রি করতে পারে।”

গোলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজ পরিত্যক্ত।

ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটির ভবিষ্যৎ জানতে চাইলে বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (চার্টার) ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বীমার অর্থ দাবি করে নোটিস দিয়েছি।

“জাহাজটির বিষয়ে এখন বীমা কোম্পানিই তাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবে। এছাড়া যুদ্ধ দ্রুত সময়ে শেষ হলে সেটি উদ্ধার বা মেরামতের বিষয়টি আসতে পারে। তবে এখন বিএসসি সংশ্লিষ্ট বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। সুতরাং এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না।”

বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর সুমন মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাহাজটির ইন্সুরেন্স কাভারেজ রয়েছে। আমরা তাদের নোটিস দিয়েছি। সে অনুযায়ী আমাদের কাজ চলছে এবং আমরা তা দ্রুত করার চেষ্টা করছি।”

বিএসসির জাহাজের বীমা করা হয় সাধারণ বীমা করপোরেশনে। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে পুনঃবীমা করে।

সাধারণ বীমার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলার সমৃদ্ধির মোট মূল্যের উপর ভিত্তি করে বীমা করা হয়। পরে বেশিরভাগ অংশ গচ্ছিত রাখা হয় বিদেশি প্রতিষ্ঠানে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন ঠিক করে দেয়।

“কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বা ক্ষতিপূরণের টাকা দাবি করলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকৃত সলিসিটারের মধ্যস্ততায় তা নির্ধারণ করা হয়।”

বিএসসির পক্ষ থেকে ৫ মার্চ বীমা দাবির চিঠি এসেছে বলে জানান তিনি।

বাংলার সমৃদ্ধির নাবিকরা, যারা এখন দেশে ফিরে আসছেন।

১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে বাংলার সমৃদ্ধিসহ মোট আটটি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি অয়েল ট্যাংকার এবং তিনটি কার্গো জাহাজ। এর মধ্যে বাংলা সমৃদ্ধিসহ ছয়টি জাহাজ ভাড়ায় দেশি-বিদেশি শিপিং প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় চলছে। বাকি দুইটি দেশের ভেতরেই লাইটারেজ হিসেবে ভাড়ায় খাটে।

২০১৮ সালের অক্টোবরে বিএসসির বহরে যুক্ত হওয়া ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ তুরস্কের একটি বন্দর থেকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইনের ওলভিয়া আউটার অ্যংকরেজে যাওয়ার পরদিন ইনার অ্যাংকরেজে নোঙর করে।

সেখান থেকে ‘সিমেন্ট ক্লে’ নিয়ে জাহাজটির ইতালির রেভেনা বন্দরে যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে পণ্য না তুলে ২৯ ক্রুসহ জাহাজটি বন্দরে থেকে যায়।

গত ২ মার্চ জাহাজের নেভিগেশন ব্রিজে রকেট হামলা হয়। এ সময় কর্মরত অবস্থায় থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান মারা যান।

একদিন বাদেই জাহাজটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ২৮ ক্রু তীরে এসে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। দেশে ফিরতে তাদের স্থলপথে রোমানিয়ায় নেওয়া হয়েছে।

আরও খবর