যুদ্ধের মধ্যে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’কে ইউক্রেইনে কেন যেতে হল?

‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজটি যেদিন ইউক্রেইনে পৌঁছল, সেদিন যুদ্ধ শুরু না হলেও তার আঁচ মিলছিল আগে থেকেই।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2022, 07:00 PM
Updated : 3 March 2022, 07:02 PM

সেই পরিস্থিতিতে কেন বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটিকে ইউক্রেইনে পাঠান হল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন দেশের নাবিকরা।

তারা বলছেন,জাহাজটি যেতে না দিলে এখন একজন নৌপ্রকৌশলীর মৃত্যু দেখতে হত না।

তবে জাহাজটির মালিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) বলছে, যাদের কাছে জাহাজটি ভাড়া দেওয়া ছিল, তাদের ইচ্ছার বিপরীতে যাওয়ার সুযোগ এই ক্ষেত্রে ছিল না।

তারপরও ইউক্রেইন যাওয়া এড়ানো যেত বলেই মনে করে বাণিজ্যিক জাহাজে কর্মরত বাংলাদেশি নাবিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ)।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের যে অ্যাসেসমেন্ট, তাতে বাংলার সমৃদ্ধির এই ইউক্রেইন যাত্রা এড়ানো যেত।

“কারণ ইউক্রেইনের পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। বিভিন্ন দিক থেকে কয়েকদিন আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, যুদ্ধ পরিস্থিতি হতে যাচ্ছে। তাই যত এগ্রিমেন্টই থাকুক। চুক্তি বাতিল করে, তুরস্ক থেকেই জাহাজকে ফেরত আনা যেত।”

যুদ্ধের মধ্যে গোলার আঘাতে জ্বলছে বাংলার সমৃদ্ধি।

বাংলার সমৃদ্ধি’র মালিকানা বিএসসির হলেও ডেনমার্কের কোম্পানি ডেলটা করপোরেশনের অধীনে সেটি ভাড়ায় চলছিল।

গত ২৬ জানুয়ারি মুম্বাই বন্দর থেকে রওনা হয়ে তুরস্কের ইরেগলিতে যায় জাহাজটি। সেখান থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইনের ওলভিয়া বন্দরের উদ্দেশে রওনা হয়।

২২ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি ইউক্রেইনের ওলভিয়া বন্দরের আউটার অ্যাংকরেজে ছিল, পরদিন ইনার অ্যাংকরেজে নিয়ে যাওয়া হয়।

ইউক্রেইনে যে এলাকায় রয়েছে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটি।

এই বন্দর থেকে সিমেন্ট ক্লে নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল বাংলার সমৃদ্ধির।

কিন্তু সেদিন ভোরে ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর কৃষ্ণ সাগরের খাঁড়ির ৫০ কিলোমিটারের মতো ভেতরে মিকোলায়েভ শহরের ওলভিয়া বন্দরে আটকে পড়ে জাহাজটি।

এরপর যুদ্ধ চলার মধ্যে বুধবার একটি গোলার আঘাত হয় বাংলাদের সমৃদ্ধির উপর, তাতে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান মারা যান।

গোলার আঘাতে মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (নেভিগেশন ব্রিজ) পুরোপুরি বিধ্বস্ত এবং প্রধান বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে বলে জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বেঁচে থাকা ২৮ নাবিককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বৃহস্পতিবার।

২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হলেও তার আগে থেকে সেখানে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব চলছিল। রাশিয়া অভিযান শুরু করছে বলে যুক্তরাষ্ট্র সতর্কবার্তা দিয়েছিল।

গোলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজ পরিত্যক্ত।

মেরিন ইঞ্জিনিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “যতটুকু জেনেছি ২১ তারিখের আগেই সেখানে ওয়ার জোন ঘোষণা করা হয়। ওয়ার জোনে সাধারণত জাহাজ পাঠানো হয় না। যদি কোনো দেশের ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট থাকে সেক্ষেত্রে সেফটি সিকিউরিটি মেইনটেইন করে পাঠানো হয়।

“বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটিও আমাদের জাতীয় সম্পদ। এরকম পরিস্থিতিতে কারা কোন বিবেচনায় জাহাজের সেখানে যাওয়ার ক্লিয়ারেন্স দিল? কারা মনিটর করলো? এটা আমাদের প্রশ্ন।”

সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে জানাতে শুক্রবার সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম নগরীর স্ট্র্যান্ড রোডে সংগঠনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বিএমএমওএ।

মেরিনারদের উন্নয়ন সংগঠন ‘অঙ্গীকার বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’র সভাপতি ক্যাপ্টেন আতিক খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যতটুকু জেনেছি, ১৫ ফেব্রুয়ারি সেখানে ওয়ার জোন ঘোষণা করা হয়। এরপর কেন জাহাজ সেখানে গেল? নাবিকদের জীবনের কী মূল্য নেই?” 

ওই জাহাজে থাকা ২৮ বাংলাদেশির পরিবার এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। তাদের মনেও প্রশ্ন, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জাহাজ ইউক্রেইনে যেতে দেওয়া হল কেন?

বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে থাকা বাংলাদেশি নাবিকরা। ছবি: বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন

কেন গেল, যে উত্তর মিলল

বাংলার সমৃদ্ধির ইউক্রেইন যাত্রার কারণ হিসেবে ভাড়া দেওয়াকেই কারণ দেখাচ্ছেন বিএসসি’র নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) ড. পীযূষ দত্ত।

চলমান পরিস্থিতিতে তিনি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “আমাদের যে চার্টার পার্টি আছে, সে অনুযায়ী ইন্স্যুরাররা যদি ওয়ার রিস্ক প্রিমিয়াম নিয়ে কোথাও যাওয়ার পারমিশন দেয়। সেক্ষেত্রে আমাদের চার্টার পার্টি অনুযায়ী সেটা অ্যালাউ করতে হয়।

“আমাদের যেমন লিবিয়াতে বা পারস্যতে বিভিন্ন সময় এরকম পরিস্থিতি হয়। সেসব ক্ষেত্রেও ওয়ার রিস্ক প্রিমিয়াম নিয়ে চার্টার পার্টি অনুসারে সেগুলো অ্যালাউ করতে হয়। সেখানে (ইউক্রেনে, বাংলার সমৃদ্ধির আশেপাশে) ২০-২২টা জাহাজ আছে। ওই কনডিশন ফুলফিল করেই সেখানে যাওয়া হয়েছে। কোনো ব্যত্যয় হয়নি।”

মেরিন ইঞ্জিনিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “কোনো জাহাজের ক্যাপ্টেন চাইলে ক্রুজ সেফটির জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটা হল জেনারেল প্র্যাকটিস।”

এই সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে পীযূষ দত্ত বলেন, “যদি জাহাজ সেখানে যাওয়ার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত, তাহলে ক্যাপ্টেন চাইলে ফিরে আসতে পারতেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয় তারা সেখানে পৌঁছনোর পরে।”

 

এমন পরিস্থিতিতে জাহাজ না পাঠিয়ে ক্ষতিপূরণের দাবির মুখেও পড়ার কথা জানান বিএসসি’র নির্বাহী পরিচালক।তার ভাষ্যে, সেক্ষেত্রে যারা ভাড়া নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মানিয়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে সেই সুযোগ পাওয়া যায়নি।

পীযূষ বলেন, “এরকম রেফারেন্স আমাদের কাছে আছে, ওয়ার জোন বলে আমরা ভেনিজুয়েলা যাইনি। কিন্তু আমাদের কাছে ৬ কোটি টাকা দাবি করেছে। এখনও সেটা পেন্ডিং আছে।

“চার্টারারকে যদি ম্যানেজ করে না যাওয়া যায়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু চার্টারার যদি চায়, আমাদের যেতে হয়। এক্ষেত্রে আমরা ইন্স্যুরারের সাথে যোগাযোগ করেছি। ওরা যেহেতু কভারেজ দিয়েছে আমাদের যেতে হবে। চার্টারার যেহেতু যেতে চায়, না পাঠানোর সুযোগ আমাদের ছিল না। যদি তারা যেতে না চাইত তাহলে হয়ত না পাঠাতে পারতাম।”

তবে এনিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিএমএমওএ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত।

“ইন্সুরেন্স কোম্পানি হয়ত ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা দিতে পারে। তবে কারও জীবনের নিশ্চয়তা তো তারা দিতে পারবে না। একজন নাবিক যে মারা গেলেন তাকে কী তার পরিবার আর ফিরে পাবে? আমরা জানতে চাই, এই মৃত্যুর আসলে কোনো দরকার ছিল কি না?”