চট্টগ্রামে মেট্রোরেল কোন পথে, ধন্দ কাটছে না

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বন্দরনগরীতে মেট্রোরেল নির্মাণ নিয়ে আলোচনার মধ্যে সামনে এসেছে রুটের বিষয়টি; বিশেষ করে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ফ্লাইওভারের কারণে এ নিয়ে ভাবনা ডালপালা মেলেছে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Jan 2022, 06:24 PM
Updated : 10 Jan 2022, 06:24 PM

আড়াই বছর আগেও মেট্রোরেল নিয়ে এক সমীক্ষায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারকে মেট্রোরেলের ‘প্রতিবন্ধকতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

এমন প্রেক্ষাপটে ব্যয়বহুল বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন প্রকৌশলীরা।

একই সঙ্গে নগরীর উপকণ্ঠের উপজেলাগুলোর সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মেট্রোরেলের রুটে এসব এলাকাকে যুক্ত করতে গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। বিশেষ করে মিরসরাইতে নির্মাণাধীন দেশের বৃহত্তম বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরকে মেট্রোরেলের রুটের সঙ্গে যুক্ত করার পরামর্শ এসেছে।

এরমধ্যেই আগামী ১৩ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের বিষয়ে একটি বৈঠকে বসছেন সংশ্লিষ্টরা। সেখানে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হবে।

সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, বৈঠকে কী নির্দেশনা আসে সেটির উপর ভিত্তি করে কার্যক্রম এগোবে।

“মাসখানেক আগেই বিস্তারিত সম্ভ্যাবতা যাচাই করতে একটি প্রস্তাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি।”

আড়াই বছর আগে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যে প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষা করেছিল সেটির ভিত্তিতেই মন্ত্রণালয়ে এ প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তখন প্রস্তাব করা হয়েছিল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে দুই লেভেলে (উপরে-নিচে) মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের।

পরীক্ষামূলক যাত্রায় মেট্রোরেল। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

“কিন্তু এলভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ ইতিমধ্যে অনেকটাই হয়ে গেছে। এখন আর তা করা সম্ভব না। সেটা ভালো প্রস্তাব ছিল।“

এখন সম্ভাব্যতা যাচাই করেই রুট নির্ধারণ করতে হবে। এর আগে ধারণা করে বলা সম্ভব না কোন পথে, কিভাবে মেট্রোরেল যাবে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের নগর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বারবার গণমাধ্যমের সামনে আমরা বলেছি। এমনকি মন্ত্রীদের সামনেও বলেছি। তখন থেকেই বলে আসছি, ভবিষ্যতে আমাদের বিআরটি বা এমআরটিতে যেতে হবে। তখনই এমআরটি করার পরিকল্পনা করা হলে এই সমস্যা হত না।“

গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেকে) বৈঠকে ঢাকার পর চট্টগ্রামেও মেট্রোরেল নির্মাণের নির্দেশ দেন।

বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন পর্যন্ত মেট্রোরেলের রুটের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

ঢাকার মেট্রোরেল (এমআরটি-৬) শেষ হওয়ার পরপরই চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণে কাজ শুরুর আগ্রহ দেখিয়েছেন তিনি।

ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ এখন পুরোদমে এগিয়ে চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার রুটে মেট্রোরেল চালু করতে চায় সরকার। এমআরটি ৬ রুটে ট্র্যাক নির্মাণের পাশাপাশি জাপান থেকে ইঞ্জিন ও কোচ আসার পর ধারাবাহিকভাবে ট্রায়ালও চলছে।

একনেকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরই বন্দরনগরীতে আলোচনায় আসে বিমানবন্দর সড়কে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের কারণে মেট্রোরেলের রুট নিয়ে। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া এ নিয়ে ‘ধন্দ’ কাটবে না বলে বলছেন প্রকৌশলীরা।

একই পথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

বিমানবন্দর সড়কে এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। পিলার নির্মাণের জন্য বোরিং করা হয়েছে মাঝ সড়কে। মোট ৩৭৮টির মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৮০টি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে।

চট্টগ্রামের কাঠগড় ও পতেঙ্গা এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিয়ারে বসেছে গার্ডার। ছবি: সুমন বাবু

নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চার লেইনের এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ১৬ কিলোমিটার। ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালে।

এটির প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বিকল্প যে কোনো পথে মেট্রোরেল হতে পারে। মিরসরাই, পটিয়া, আনোয়ারার মত বর্ধনশীল এলাকাগুলোকে মেট্রোরেলের পথে সংযুক্ত করতে হবে। তাহলে সংযোগ বাড়বে।”

মেট্রোরেলের রুট: আগের প্রস্তাবে কী ছিল

২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্টস লিমিটেড নগরীতে মেট্রোরেলের তিনটি র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইনের প্রস্তাব করে।

তিনটি রুটে মোট সাড়ে ৫৪ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন ও ৪৭টি স্টেশন প্রস্তাব করা হয়। প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা ধরে সম্ভাব্য মোট ব্যয় ধরা হয় ৮৫ হাজার কোটি টাকা।

এর মধ্যে কালুরঘাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-১ এর দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ২৬ কিলোমিটার (২০টি স্টেশন), সিটি গেইট থেকে নিমতলা হয়ে শাহ আমানত সেতুর গোল চত্বর পর্যন্ত লাইন-২ এর দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার (১২টি স্টেশন) এবং অক্সিজেন থেকে ফিরিঙ্গিবাজার ও পাঁচলাইশ থেকে একেখান পর্যন্ত লাইন-৩ এর দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ১৪ কিলোমিটার (স্টেশন ১৫টি)।

এরমধ্যে কালুরঘাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রস্তাবিত লাইন-১ এর পথে থাকা বহদ্দারহাট-লালখান সড়কের আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার এবং লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়কে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

কী বলছেন প্রকৌশলীরা

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম নামের একটি সংগঠন অপরিকল্পিতভাবে বন্দরনগরীতে ফ্লাইওভার নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছে। একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে ফোরামের পক্ষ থেকে এর কারণও জানানো হয়।

২০১৫ সালে সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের সহ সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেছিলেন, আখতারুজ্জামন ফ্লাইওভার সম্প্রসারণ হলে (পরবর্তীতে তা এলভিটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়িত হচ্ছে) ভবিষ‌্যতে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) করার জন্য তা প্রতিবন্ধকতা হবে।

সল্টগোলা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং অংশে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। ছবি: সুমন বাবু

শনিবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন বিমানবন্দর পর্যন্ত এমআরটি করা হলে এত বিপুল খরচে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কেন করা হচ্ছে? এটা তখন কারা ব্যবহার করবে?

“একই উদ্দেশ্যে বিআরটি করলেই হত। শুধু ফ্লাইওভার বা মেট্রোরেল করলেই হবে না, সঠিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও লাগবে।“

আগেই এমআরটি করার পরিকল্পনা করা হলে এ সমস্যা হত না উল্লেখ করে তার প্রশ্নব আদৌও প্রয়োজনীয় বিকল্প ভূমি আছে কী?

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমত, বিদ্যমান সড়কের ওপর দিয়েই যে ফ্লাইওভার বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে হবে এমনটা নয়। যত কম পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় সেলক্ষ্যে এসব অবকাঠামো করা হয়। সেভাবেই এগুলো প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে বিকল্প রুটেও করা যেত, যা হয়নি।

“আমরা যদি এমআরটি দিয়েই চট্টগ্রামে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু করতাম তাহলে ফ্লাইওভার আর প্রয়োজন হত না। সবার আগে বিআরটি যদি করতাম তা সবচেয়ে ফলপ্রসু হত।“

এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, “বিদ্যামান সড়ককে কেন্দ্র করেই এমআরটি করতে হবে এমন নয়। কম দূরত্ব পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছা যায় এমন রুট খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য বিস্তারিত সমীক্ষা করা খুব জরুরি।

“শুধু নগরী নয় মেট্রোরেলের রুটে অবশ্যই মীরসরাইকে যুক্ত করতে হবে। চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে অবশ্যই দ্রুত যোগাযোগ থাকতে হবে দেশের সর্ববৃহৎ এ শিল্প এলাকার।

“পাশাপাশি হাটহাজারী, পটিয়া, সীতাকুণ্ড ও আনোয়ারার মত দ্রুত বর্ধনশীল কেন্দ্রগুলোকে মেট্রোরেলের মাধ্যমে নগরীর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।”

আরও পড়ুন