‘পরীর পাহাড়’ সংরক্ষণেই কালুরঘাটে কমপ্লেক্স: জনপ্রশাসন সচিব

চট্টগ্রামের আদালত ভবন যেখানে অবস্থিত, সেই কোর্ট হিল বা ‘পরীর পাহাড়’ সংরক্ষণ করার জন্যই কালুরঘাটে সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজম।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2022, 04:17 PM
Updated : 6 Jan 2022, 04:17 PM

বৃহস্পতিবার নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় কালুরঘাট সেতুর পাশে সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্সের জন্য প্রস্তাবিত এলাকা পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।

কে এম আলী আজম বলেন, “প্রায় ৭৫ একর জমি নিয়ে আমরা সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্স নির্মাণের চিন্তা করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে অবগত হয়েছেন। পদ্ধতিগত দিকগুলো অনুসরণ করে এ বিষয়ে যা করণীয় সেটি আমরা করব।

“দেশ এখন উন্নত হচ্ছে, উন্নত দেশের সরকারি অফিসের পরিবেশ ‍সুন্দর করা প্রয়োজন। সুন্দর পরিবেশে সরকারি কর্মকর্তারা অফিস করবেন, সেখান থেকে ভালো ফল আমরা পাব। যে কারণে এখন যেসব অফিস আমরা করছি, তার চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও ভেতরের অবয়বে পরিবর্তন আসছে। সবকিছু বিবেচনা করেই করা হবে। এখানে সেবাগ্রহীতারা আসবেন। তাদের কী কী সুবিধা প্রয়োজন- সব বিবেচনা করে সকল অবকাঠামো গড়ে তুলব। সবকিছু বিবেচনা করে আমরা কাজ করব।”

এ কমপ্লেক্স নির্মাণে আর কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হবে কি না জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, “আমরা আপাতত ৭৫ একর নিয়েই এগোচ্ছি। পরে প্রয়োজন হলে জমি অধিগ্রহণ বিবেচনা করা হবে। আপাতত যা আছে, সেটি নিয়েই শুরু করব। সরকারের সকল বিভাগই সরকারের প্রয়োজনীয়। সকলকে নিয়েই সরকার। সকল বিভাগের কাজের সমন্বিত ফল নিয়েই সাফল্য আসে। যেখানে যার প্রয়োজন সেখানে সীমাবদ্ধ জমিতেই সবাইকে অ্যাকমোডেট করব।”

কর্ণফুলী নদীর তীরে এ কমপ্লেক্স নির্মাণে পরিবেশগত কোনো ঝুঁকি থাকছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বড় প্রকল্পের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ইমপ্যাক্ট অ্যানালাইসিস করে নেব। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়েই কাজ করা হবে।

“এটা দ্বিতীয় রাজধানী। চট্টগ্রামের আলাদা ঐতিহ্য আছে। এখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য ছোট একটা অফিস আমরা রাখতে চাই।”

কোর্ট হিলে বর্তমান আদালত ভবন, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর রয়েছে। সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্স হলে সেখান থেকে এবং নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা সরকারি দপ্তরগুলো এখানে চলে আসবে।

সেক্ষেত্রে পরীর পাহাড়ের কী হবে জানতে চাইলে আলী আজম বলেন, “পরীর পাহাড় একটা ঐতিহ্যবাহী স্থান। সুদূর অতীত থেকে এর একটা ঐতিহ্য চলে আসছে। এটিকে সংরক্ষণে সরকারের সদিচ্ছা আছে। সংরক্ষণ করার জন্য যে ব্যবস্থা এর অংশ হিসেবেই এখানে সমন্বিত সরকারি কমপ্লেক্স করছি।

“পরীর পাহাড়ে... মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, অবৈধ স্থাপনা যেখানেই আছে শুধু পরীর পাহাড় নয় বা শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারা বাংলাদেশে যে অবৈধ স্থাপনা আছে তা আমরা উচ্ছেদের পক্ষপাতী।সরকার সেভাবেই বিবেচনা করছেন এবং সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আদালত ভবনের জন্য জায়গা রাখা আছে। কাউকে বাদ দিয়ে নয় সবাইকে নিয়েই সরকারি কর্মকাণ্ড। কাউকে বাদ দেওয়া, কাউকে পিছনে ফেলা- এটা সরকারের উদ্দেশ্য নয়।”

চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান ও জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমানসহ সরকারি কর্মকর্তারা পরিদর্শনের সময় উপস্থিত ছিলেন।

আদালত ভবন এলাকায় আইনজীবীদের চেম্বারের জন্য নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে জেলা প্রশাসন ও আইনজীবী সমিতির দ্বন্দ্বের মধ্যেই সম্প্রতি পরীর পাহাড়ের ১৩০ বছরের পুরনো দ্বিতল আদালত ভবনটিকে 'হেরিটেজ' ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছে জেলা প্রশাসন। 

ওই পাহাড়ে থাকা চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং নগরীর অন্যত্র থাকা সরকারি দপ্তর মিলিয়ে মোট ৪৪টি সরকারি অফিস যাবে কালুরঘাটে।

পাহাড়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণ না করতে এবং অবৈধ স্থাপনা অপসারণে ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তাতে সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

সেখানে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা অপসারণ ও সংস্কার বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গত বছরের ২৯ অগাস্ট চিঠি দেয়।

ওই পাহাড়ের চূড়ায় পুরাতন আদালত ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৮৯৩-৯৪ সালে। পুরনো ভবনটি ভাঙার উদ্যোগ নেওয়া হলে ঐতিহ্য সংরক্ষণের দাবিতে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ আন্দোলন গড়ে তোলে।

পরে ২০১০ সালে পুরাতন ভবনের পিছনে চারতলা নতুন আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়। সংস্কারের পর শতবর্ষী পুরাতন আদালত ভবনটি তখন থেকে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

সপ্তদশ শতাব্দীতে আরাকানি শাসনে ‘ফেয়ারি হিল’ ছিল পতুর্গিজদের সম্পত্তি। ইংরেজ শাসনামলে হাতবদল হয়ে ঊনবিংশ শতকের মাঝমাঝি সময়ে তা বাঙালি জমিদার অখিল চন্দ্র সেনের হাতে আসে।

১৮৮৯ সালে অখিল চন্দ্রের কাছ থেকে ‘পরীর পাহাড়’ হিসেবে পরিচিত এই পাহাড় কিনে নেয় ব্রিটিশ সরকার। ১৮৯৩-৯৪ সালে ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে রাইটার্স বিল্ডিং এর আদলে দুই তলা আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়।

এ ভবন নির্মাণে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদনকারী সেসময়ের বিভাগীয় কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারী কবি নবীন চন্দ্র সেন আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কমিশনার, জজ, কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেটমহ সব অফিসের সমাবেশ ঘটাতে পরীর পাহাড়ে বৃহৎ অট্টালিকা করার প্রস্তাব করেছিলেন তিনি।

পুরনো খবর