আইসিইউ’তে ভর্তি কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা, শ্বেত রক্ত কনিকা, সি-রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিন (সিআরপি), ফেরিটিন ও ডি-ডাইমারের মাত্রা মারাত্মক রকমের কম-বেশি ছিল বলে এ গবেষণায় উঠে আসে।
রক্তের এসব উপাদানগুলোর সঙ্কটপূর্ণ মাত্রা কোভিড-১৯ রোগীর স্বাস্থ্য ও মৃত্যুঝুঁকির শঙ্কা নির্দেশ করে।
চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ এর জন্য বিশেষায়িত ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীদের রক্তের বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা বিশ্লেষণ করে মৃত্যুঝুঁকির সম্ভাব্যতা যাচাইকরণ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনে এতথ্য উঠে আসে।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম জেনালে হাসপাতাল যৌথভাবে এ গবেষণা করেন। সিভাসু উপাচার্য অধ্যাপক ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইলের নেতৃত্বে এ গবেষণা করা হয়।
গবেষণার জন্য এ বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ২৩৪ জন কোভিড-১৯ রোগীর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়।
এসব রোগীর মধ্যে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ (১৫৬ জন) মারা গেছেন, সুস্থ হয়ে ফিরেছেন ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ (৭৮ জন)। মারা যাওয়া রোগীদের ৭৩ শতাংশেরই বয়স ৫০ বছরের বেশি।
বুধবার দুপুরে সিভাসু সম্মেলন কক্ষে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল।
গবেষক দলের সদস্য চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবদুর রব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যেসব রোগী আইসিইউতে ছিল তাদের রক্তের উপাদান পরীক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি পরীক্ষা করা হয়।
“এতে দেখা গেছে যেসব আক্রান্ত ব্যক্তি আইসিইউতে চিকিৎসা নিয়ে মারা গেছেন বেশিরভাগই স্বাস্থ্য জটিলতায় আগে থেকে ভুগছিলেন। তাদের বেশিরভাগেরই হিমোগ্লোবিন, অক্সিজেন মাত্রাতিরিক্ত কমে গিয়েছিল। আর ট্রপোনিন, ডি ডাইমার, সিআরপি অনেক বেশি পাওয়া গেছে।”
তিনি বলেন, এই গবেষণা ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় চিকিৎসকদের সহায়ক হতে পারে। এছাড়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত বয়স্কদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাদের কো মরবিডিটি আছে তাদের অবশ্যই আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮৯ দশমিক ১ শতাংশ (১৩৯ জন) কো মরবিডিটি বা আগে থেকেই বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন। এদের মধ্যে ৯৩ জন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাঁপানি, উচ্চরক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
এতে বলা হয়, ৯৮ ভাগ রোগীর রক্তে সি–রিএক্টিভ প্রোটিনের (সিআরপি) পরিমাণ ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। স্বাভাবিক মাত্রা লিটারে ৫ মিলিগ্রামের কম। কিন্তু সিআরপি প্রতি লিটারে গড়ে ১০২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
এছাড়া মারা যাওয়া প্রায় ৭৩ শতাংশ রোগীর রক্তে অক্সিজেনের চাপ ছিল ৫০ দশমিক ৪ মিলিমিটার, যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা ৭০ থেকে ৯০ মিলিমিটার থাকার কথা।
৫১ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম। যার গড় পরিমাণ ১০ দশমিক ৬ মিলিমিটার, যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা থাকার কথা ১২ থেকে ১৭ গ্রাম/ডেসিলিটার।
মারা যাওয়া ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ রোগীর রক্তে শ্বেতকণিকার মান পাওয়া গেছে স্বাভাবিক মাত্রার বেশি। যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা ৪০০০ থেকে ১১০০০ ঘন মিলিমিটার, সেখানে পাওয়া গেছে ২৬১১০ দশমিক ৬ ঘনমিটার, যা মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।
আইসিইউতে মারা যাওয়া ৭৫ শতাংশ রোগীর রক্তে ফেরিটিনের স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে। স্বাভাবিক মাত্রা ৯ থেকে ৩৭০ ন্যানোগ্রাম/মিলিলিটারে হলেও পাওয়া গেছে প্রতি মিলি লিটারে ৯০১ দশমিক ৫ ন্যানোগ্রাম।
৬৫ দশমিক ২ শতাংশ মৃত্যুবরণকারী কোভিড-১৯ রোগীর রক্তে ডি–ডাইমারের পরিমাণ স্বাভাবিকের (০.৫ মাইক্রোগ্রাম/মিলিলিটারের কম) চেয়ে উচ্চমাত্রা পরিলক্ষিত হয়, যা ছিল ২ দশমিক ০২ মাইক্রোগ্রাম।
প্রায় ৭৬ শতাংশের রক্তে ট্রপোনিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মিলেছে, যা শূন্য দশমিক ৮১ ন্যানোগ্রাম পর্যন্ত ছিল। অথচ স্বাভাবিক মাত্রা শূন্য দশমিক ০৪ ন্যানোগ্রাম।
গবেষণায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক বিদ্যুৎ বড়ুয়া, সিভাসুর সহকারী অধ্যাপক ইফতেখার আহমেদ রানা, জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবদুর রব, জুনিয়র কনসালটেন্ট রাজদ্বীপ বিশ্বাস, জুনিয়র কনসালেটন্ট মৌমিতা দাশ, সিভাসুর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ত্রিদীপ দাশ, সিভাসুর মলিকুলার বায়োলজিস্ট প্রনেশ দত্ত, সিরাজুল ইসলাম ও তানভির আহমেদ নিজামী যুক্ত ছিলেন।
প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে গবেষক দলের সদস্যরা ছাড়াও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির।