হালদায় আরেকটি ডলফিনের মৃত্যু, কারণ অনুসন্ধানের পরামর্শ

হালদা নদীতে আরেকটি ডলফিন মারা গেল। এনিয়ে দুই মাসে হালদা ও কর্ণফুলী নদী এবং সংলগ্ন শাখা খালে পাঁচটি মৃত ডলফিনের দেখা মিলল। এর মধ্যে বেশিরভাগের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2021, 03:50 PM
Updated : 4 Oct 2021, 03:50 PM

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে হালদায় ৩১টি এবং কর্ণফুলীতে ২টি মৃত ডলফিনের সন্ধান মেলে। এই হারে ডলফিনের সংখ্যা কমতে থাকলে হালদা ও কর্ণফুলী ডলফিন শূন্য হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

সোমবার সকালে হালদা নদীর রামদাস মুন্সীর হাট এলাকায় বেসরকারি সংস্থা আইডিএফের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা নদীতে একটি মৃত ডলফিন ভাসতে দেখে নৌ পুলিশকে খবর দেয়। 

নৌ পুলিশের এসআই মো. আশরাফুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েক দিন আগেই এটি মারা গেছে। সবার সাথে আলাপ করে সেটি নদী তীরেই মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে।” 

ডলফিনটির শরীরের কিছু অংশ কাক খুবলে নিয়েছিল। দুর্গন্ধ ছড়ানোয় এটির আকার ও ওজন পরিমাণ সম্ভব হয়নি।

এর আগে গত ৩০ অগাস্ট হাটহাজারী মদুনাঘাট বড়ুয়া পাড়া সংলগ্ন অংশে আরেকটি মৃত ডলফিন পেয়েছিল নৌ পুলিশের টহল দলের সদস্যরা। সেটির শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না।

গত ১ অগাস্ট কর্ণফুলী নদীর হামিদ চর এলাকায় এক বছর বয়সী সাড়ে তিন ফুট দৈর্ঘ্যের আরেকটি ডলফিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়, তার শরীরেও কোনো জখম ছিল না।

৬ জুলাই হাটহাজারী উপজেলার মেখল ইউনিয়নের চানখালী খালের ব্রিজের কাছে একটি ডলফিনের মৃতদেহ মেলে। বয়সের কারণে স্বাভাবিক নিয়মেই সেটির মৃত্যু হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।

এর আগে ২০১৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে হালদায় ও শাখা খালে মারা যায় মোট ১৬টি ডলফিন। এর মধ্যে বেশিরভাগের শরীরে আঘাতের চিহ্ন মিলেছিল। সে সময় নদীতে চলাচলকারী বালু উত্তোলনকারী ড্রেজারের আঘাতে ডলফিন মারা পড়ছিল বলে জানিয়েছিল সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি মৃত ডলফিনগুলোর শরীরে তেমন কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি। মাছই ডলফিনের প্রধান খাবার। মাছের পিছে ছুটতে গিয়ে জালে আটকা পড়লে বেশিক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পেরে ডলফিনগুলো মারা পড়ছে বলে ধারণা।

হালদায় মা মাছ শিকারের জন্য জাল পাতা হয় নিয়মিত। পাশাপাশি নদীর তীর রক্ষায় বসানো ব্লকে এবং নদীতে চলাচলকারী নৌযানের সাথে ধাক্কা খেয়েও ডলফিন মরতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

গত ১৫ জুলাই বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব গোমদণ্ডী এলাকায় কর্ণফুলী নদীর ছন্দারিয়া খালে প্রায় ৭ ফুট লম্বা ১০০ কেজি ওজনের ডলফিনের মরদেহ উদ্ধার হয়। যার পিঠে আঘাত ছিল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণীবিদ্যা বিভোগের অধ্যাপক ও হালদা রির্সাচ কেন্দ্রের সমন্বয়ক মনজুরুল কিবরীয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকের ডলফিনটি প্রাপ্তবয়স্ক। তবে এটি এতটাই পচে গেছে যে আঘাত শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কমপক্ষে ২দিন আগে এটি মারা গেছে।

“ধারণা করছি, সম্প্রতি বেশিরভাগ ডলফিন জালে আটকে মারা যাচ্ছে। এরা শ্বাস নেয় পানির উপর থেকে। কিছু সময় পর পর। তাদের লম্বা ঠোঁট ও করাতের মত দাঁত আছে। মাছের পিছে ছুটতে গিয়ে হয়ত জালে আটকে যায়। বেশিক্ষণ শ্বাস নিতে না পারলে ডলফিন মারা যায়।”

হালদা নদীতে জাল পাতা বন্ধের দাবি জানিয়ে অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, “তা হলে মা মাছ ও ডলফিন রক্ষা করা হবে। জালে সমানভাবে মা মাছও মারা যাচ্ছে। শিকারীরা মাছ নিয়ে যায়। ডলফিন ভাসিয়ে দেয়।”

হাটহাজারী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন নদীতে বালুবাহী ড্রেজার চলে না। তবে জালে আটকা পড়লে ডলফিনের মুখে জালের অংশবিশেষ আটকে থাকে। এরকম অতীতে দুয়েকবার দেখেছি। মাছের পিছে ছুটতে গিয়ে সিমেন্টের ব্লকে আঘাতের কারণেও ডলফিনের মৃত্যু হতে পারে।”

তিনি বলেন, “ডলফিন পরিবেশের একটা ইনডিকেটর। পরিবেশ ভালো না থাকলে ডলফিন টিকতে পারে না। সম্প্রতি মৃত ৫টির মধ্যে চানখালী খালেরটি ছিল পূর্ণবয়স্ক। সেটি হয়ত বয়সের কারণেই মারা গেছে।”

ডলফিনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন দেখছেন নাজমুল।

“হালদার বিভিন্ন দিক যেমন- পানির মান, জীব বৈচিত্র্য, আশেপাশের পরিস্থিতি সব নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন। যত বেশি গবেষণা হবে তত তথ্য জানা যাবে।”

হুমকিতে ডলফিন

হালদা নদীতে যে ডলফিনের দেখা মেলে, তা গাঙ্গেয় ডলফিন প্রজাতির। ইংরেজিতে একে বলা হয় Ganges River Dolphin; এর বৈজ্ঞানিক নাম Platanista gangetica । স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় হুতুম বা ‍শুশুক।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) গাঙ্গেয় ডলফিনকে বিপন্ন হিসেবে লাল তালিকায় রেখেছে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুসারে এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

এই প্রজাতির ডলফিন বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের নদীতে দেখা যায়। এরমধ্যে ভারতের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র, বাংলাদেশের পদ্মা, সুন্দরবনের আশেপাশের নদী এবং চট্টগ্রামের হালদা ও কর্ণফুলী এর বিচরণ ক্ষেত্র।

ডলফিনের চোখ নেই। মূলত শব্দ তরঙ্গ ছুড়ে এরা চলাফেরা ও খাবার সন্ধান করে। এদের শরীরের গঠনও নরম প্রকৃতির।

গত ৩০ অগাস্ট হাটহাজারী মদুনাঘাট বড়ুয়া পাড়া সংলগ্ন অংশে মৃত ডলফিনটি পেয়েছিল নৌ পুলিশের টহল দলের সদস্যরা। ফাইল ছবি

এক দশক আগেও কর্ণফুলীতে নিয়মিত ডলফিনের দেখা মিলত। তবে দূষণের কারণে এখন তা বিরল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর মনজুরুল কিবরিয়া জানান, ২০২০ সালে জরিপ চালিয়ে হালদায় ১২৭টির মতো ডলফিনের উপস্থিতি মিলেছিল। 

গত চার বছরে মোট ৩৩টি ডলফিনের মৃত্যু এই প্রজাতি শঙ্কার মুখে ঠেলে দিয়েছে বলে মত এই হালদা গবেষকের।   

মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “ডলফিনের গর্ভকাল প্রায় ১০-১১ মাস। ২ বছর পরপর একটি মাত্র বাচ্চা দেয়। ৯-১০ বছর বয়স হলে বাচ্চা দিতে শুরু করে। এদের জীবনকাল সর্বোচ্চ ২৫ বছর। এরমধ্যে শেষ ৫ বছর বাচ্চা দেয় না ডলফিন। সে হিসেবে একটি ডলফিন তার জীবনকালে হয়ত সর্বোচ্চ ৫-৬টি বাচ্চা দিতে পারে।

“এভাবে মরতে থাকলে তা ডলফিনের সংখ্যায় বড় প্রভাব পড়বে। এখনই রক্ষা করা না গেলে হালদা ডলফিন শূন্য হয়ে যাবে।”  

ডলফিন বাঁচাতে নদী তীরের বাসিন্দাদের সচেতনতাই একমাত্র পথ মন্তব্য করে মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থা সক্রিয়। নদীতে জাল ফেলে স্থানীয়রাই। বাইরের কেউ এসে মাছ শিকার করে না।

“স্থানীয়রা যদি ডলফিন ও মা মাছ রক্ষায় অংশগ্রহণ না করে এবং সচেতন না হয় তাহলে পরিস্থিতি হবে খুব ভয়াবহ ও দু:খজনক।”