‘আমাদের পুরো পরিবার শেষ এর জন্য’, বললেন জঙ্গি জাবেদের পিতা

জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা জঙ্গি জাবেদ ইকবালের পিতা মনে করেন, কম বয়সে ‘ভুল বুঝিয়ে’ তার ছেলেকে এ সংগঠনে যুক্ত করা হয়েছিল; যেজন্য তাদের পরিবারকে মূল্য দিতে হয়েছে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Oct 2021, 02:23 PM
Updated : 3 Oct 2021, 02:23 PM

রোববার ১৬ বছর আগে চট্টগ্রাম আদালত ভবন এলাকায় বোমা হামলার দায়ে জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমান্ডার জাবেদ ইকবালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।

এদিন এ মামলার অপর আসামি জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ ভারতের কারাগারে বন্দি জাহিদুল ইসলাম মিজান ওরফে বোমা মিজানকে ফাঁসির সাজা দেয় চট্টগ্রামের সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল।

ছেলের সাজা ঘোষণার দিনে চট্টগ্রামের আদালতে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আবদুল আউয়াল। শুধু এদিন নয়, যতবারই ছেলেকে আদালতে আনা হয়েছে তিনি চট্টগ্রামে এসেছেন। ছেলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন।

রোববার রায় ঘোষণার পর গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে ছেলের জঙ্গি কর্মকাণ্ডে হতাশ এ পিতা নিজের সন্তান এবং জেএমবির মতবাদ বিষয়ে কথা বলেন।

জাবেদকে নিয়ে অনেক আশা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ছেলের জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়ায় পুরো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চার সন্তানের মধ্যে ও (জাবেদ) দ্বিতীয়। লেখাপড়ায় ছিল মেধাবি। আমার স্বপ্ন ছিল সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে।

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। ঢাকায় তার সাথে সঙ্গে আমি দেখাও করতে গিয়েছিলাম। আজ আমাদের পুরো পরিবার শেষ এর জন্য।”

কোন সময়ে জাবেদ জেএমবিতে জড়িত হয় জানতে চাইলে তা ঠিকভাবে মনে করতে পারেননি জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ে ক্ষুব্ধ এ পিতা। তিনি বলেন, “তালেবান যখন ক্ষমতায় আসে প্রথম। এরপরই সে জেএমবিতে যুক্ত হয়। তখন ছিল হাইলি মোটিভেটেড।”  

২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রাম আদালত ভবনে তল্লাশি চৌকির সামনে জেএমবি সদস্যদের এ বোমা হামলায় পুলিশ কনস্টেবল রাজীব বড়ুয়া ও শাহাবুদ্দিন নামে এক বিচারপ্রার্থী নিহত হন। আহত হন ১০ জন।

জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত জাবেদ এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলেও এখন ‘অনুতপ্ত’ হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের বিচারক তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

তার বাবা মাদ্রাসা শিক্ষক আবদুল আউয়াল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বলেন, “যা হবার হয়ে গেছে। না বুঝে জেএমবি করেছিল। ১৯ বছর বয়সে সে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পুরো বুঝতে পারেনি।

“পরে নিজেও বুঝতে পেরেছে, এটা ইসলামের পথ না। এটা ভুল। নিজেই অনুতপ্ত বলে জানিয়েছে। সে একটা স্টেটমেন্ট দিয়েছে দ্রুত বিচার আদালতে।”

কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়নের বাসিন্দা আউয়াল জানান কর্মজীবনের শুরুতে স্কুলে এবং পরে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন তিনি।

ছেলেকে ‘বিপথে’ যাওয়ায় ব্যথিত এ পিতা বলেন, “আমি জেএমবির বিরুদ্ধে। আজীবন আমি এসব জঙ্গিপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। এটা ইসলাম নয়। এগুলো ইসলামের বিরুদ্ধের পথ। জেএমবি হল বাতিল, খারিজি মতবাদ।”

রায় ঘোষণার সময় আদালতে বাবার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চান জাবেদ। বিমর্ষ কণ্ঠে বলেন, “একটু বাবার সাথে দেখা করতে চাই। যদি সুযোগ দেন।” রায় ঘোষণার পর আদালতের অনুমতি পেয়ে আবদুল আউয়াল ছেলের সঙ্গে দেখা করেন।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ মামলার সাক্ষ্য চলাকালে প্রতিবার জাবেদের বাবা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”

চট্টগ্রামের আদালতে আত্মঘাতী বোমা হামলা মামলায় রোববার দেওয়া যাবজ্জীবন সাজার বিষয়ে তিনি বলেন, “অন্য ঘটনায় সে জড়িত। তবে এটাতে জড়িত না। তাই যাবজ্জীবন বেশি সাজা। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। শাস্তি তো একটা হবেই। তবে এটা কনসিডার করা দরকার।”

রোববার এ মামলায় সাজা পাওয়ার আগেই চট্টগ্রামের ১৫টি ও কক্সবাজারের দুটি মামলায় জাবেদ ইকবাল মোট ২০৬ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে।

চট্টগ্রামে সিরিজ বোমা হামলা, আদালত কক্ষে বোমা ও আদালত এলাকায় আত্মঘাতী বোমা হামলা এসব ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন জেএমবির সেসময়ের সামরিক কমান্ডার জাবেদ ইকবাল ওরফে মোহাম্মদ এবং বোমা কারিগর জাহিদুল ইসলাম মিজান ওরফে বোমা মিজান বলে পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে।

আদালতে বোমা হামলার আগে ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্টে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার দিনে চট্টগ্রামের ১৯ স্থানে বোমা হামলা করে জেএমবি। এতে আহত হয় ১০ জন।

ওই ঘটনায় নগরীর ৮থানায় হওয়া আটটি মামলার মধ্যে সাতটিতেই বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় জাবেদ ইকবালের।

এরপর ২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর চট্টগ্রামের দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন এবং মহানগর হাকিম আকরাম হোসেনের এজলাসে হামলা চালায় জেএমবি। বই ও জ্যামিতি বক্সের ভিতরে রাখা বোমা ছোড়া হলেও তা বিস্ফোরিত হয়নি। তাই ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি।

ওই ঘটনায় করা একটি মামলায় ২০০৮ সালে দেওয়া রায়ে জাবেদ ইকবাল ও বোমা মিজানসহ চার জঙ্গির প্রত্যেকের ২৬ বছর করে সাজা হয়। আরেক মামলায় এই দু’জনসহ তিন জঙ্গির ১৪ বছর করে সাজা হয় ২০১৭ সালে।