চট্টগ্রামে পরীর পাহাড়ে ভবন নির্মাণ নিয়ে দ্বন্দ্বে প্রশাসন ও আইনজীবী সমিতি

চট্টগ্রামের আদালত ভবন যেখানে, সেই পরীর পাহাড়ে দুটি ভবন নির্মাণকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে আইনজীবী সমিতি ও জেলা প্রশাসন।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীচট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2021, 07:26 PM
Updated : 3 Sept 2021, 07:26 PM

সমিতির ওই দুই নতুন স্থাপনা নির্মাণকে জেলা প্রশাসন বলছে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’; আর সমিতির দাবি, নিয়ম মেনে ‘অনুমোদন’ নিয়েই তারা ভবন করছেন।

প্রায় ১৩০ বছর আগে নগরীর কেন্দ্রে অবস্থিত পরীর পাহাড়ে আদালত ভবনের কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানে বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, নতুন আদালত ভবন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন এবং আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনসহ বেশ কিছু সরকারি কার্যালয় রয়েছে।

চট্টগ্রামে আইনজীবীদের চেম্বারের চাহিদা মেটাতে বিদ্যমান আইনজীবী ভবন (মূল ভবন) ও শাপলা ভবনের পাশে আরও দুটি নতুন ভবন করার উদ্যোগ নিয়েছে সমিতি।

নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০০৮ অনুযায়ী পাহাড় বা টিলা শ্রেণির জমির কোনো রূপ পরিবর্তন করা যাবে না। এটা আইনি বাধ্যবাধকতা। বাঁশখালী, মিরসরাই, লোহাগাড়াতে অনেক পাহাড় কাটা বন্ধ করেছি। চট্টগ্রামের অবৈধ ১৫৬টি ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে পাহাড় শ্রেণির জমিতে হওয়াতে।

“যেহেতু এটিও পাহাড় শ্রেণির জমি। তাই চাইলেও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু করতে পারব না।”

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এএইচ এম জিয়া উদ্দিন বলেন, “দুটি ভবনে ছয়শ চেম্বার হবে। ভবনের জমি আইনজীবী সমিতির। আর শাপলা ভবন করার সময় সেসময়ের জেলা প্রশাসক আমাদের সীমানাও চিহ্নিত করে দেন। এর বাইরে আমরা যাচ্ছি না।“

চট্টগ্রামে পরীর পাহাড়ে অবস্থিত আদালত ভবন

আইনজীবীদের এই নেতা বলেন, “সিডিএ এর কাছে আমাদের ভবনের অনুমোদন বিষয়ে উনি (জেলা প্রশাসক) জানতে চেয়েছিল। সিডিএ জানিয়েছে, অনুমোদন আছে। আমাদের ভবন পাহাড়ে নয়। স্ট্রাকচারের নিচের দিকের অংশ বিশেষ ঢালু জমিতে।

“উনার কার্যক্রম ব্রিটিশ আমলের চিন্তাধারার বহি:প্রকাশ। এটা নিয়ে আমরা অবস্থানে যাব, আমরা যখন কাজ শুরু করব। আগে কখনও এরকম হয়নি। বরং আগের ডিসিরা কথা বলে করেছেন, যা করার। পরীর পাহাড়ে তিনটি পার্ট- জেলা প্রশাসন, জেলা আদালত, আইনজীবী সমিতি। অস্বস্তিকর পরিবেশ কল্যাণকর নয়। আলোচনা করে সব করা যায়।”

এই বিষয়ে জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন, “অনুমোদন থাকলে তো কোনো সমস্যা নেই। উদ্বিগ্ন হওয়ারও কোনো কারণ নেই।”

পরীর পাহাড়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি বৃহস্পতিবার স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশ করে জেলা প্রশাসন। এরপর বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন আইনজীবীরা। যদিও জেলা প্রশাসক বলছেন, এই বিজ্ঞপ্তি কাউকে উদ্দেশ্যে করে তারা দেননি।

বিজ্ঞপ্তিতে জেলা প্রশাসন বলছে, পরিকল্পনাহীন বেশকিছু ‘অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা’ ইতিমধ্যে হয়েছে। এসব স্থাপনার কারণে মানবিক বিপর্যয় হতে পারে এবং ঐতিহাসিক পাহাড়টি রক্ষা সাংবিধানিক দায়িত্ব।

সরকারি খাস জমিতে ‘অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ’ দণ্ডনীয় অপরাধ উল্লেখ করে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের হুশিয়ারি দেয়া হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

পরীর পাহাড়ে ওঠার পথে আইনজীবী ভবন

পরীর পাহাড় আদালত পাড়া হল কখন

সপ্তদশ শতাব্দীতে আরাকানি শাসনে ‘ফেয়ারি হিল’ ছিল পতুর্গিজদের সম্পত্তি। ইংরেজ শাসনামলে হাতবদল হয়ে উনবিংশ শতকের মাঝমাঝি সময়ে তা বাঙালি জমিদার অখিল চন্দ্র সেনের হাতে আসে।

১৮৮৯ সালে অখিল চন্দ্রের কাছ থেকে ‘পরীর পাহাড়’ হিসেবে পরিচিত এই পাহাড় কিনে নেয় ব্রিটিশ সরকার।

১৮৯৩-৯৪ সালে ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে রাইটার্স বিল্ডিং এর আদলে দুই তলা আদালত ভবন নিমার্ণ করা হয়। সেই থেকে সোয়া একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ভবনে বিচারিক কার্যক্রম চলছে। পরে বিভিন্ন সময় ভবনটি সংস্কার করা হয়।

২০১০ সালে পুরাতন আদালত ভবনের পিছনে চারতলা নতুন আদালত ভবন নির্মাণ করা হয় ৩২ কোটি টাকা খরচে। শতবর্ষী পুরাতন আদালত ভবনটি সংস্কার করে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এখান থেকে।

সাড়ে তিনশ ‘অবৈধ স্থাপনা’

পরীর পাহাড়ের একেবারে শীর্ষে স্থাপিত আদালত ভবন। সেখানে ওঠার দুই পথের পাশে খাবার হোটেল, স্টেশনারি দোকান, ফটোকপির দোকান, কাঁচাবাজার, শুটকির বাজার এমনকি কাপড়চোপড়ও বিক্রি হয় কিছু দোকানে।

কর্মদিবসে শত শত গাড়ির জট লেগেই থাকে নিচ থেকে পাহাড়ের ওপর পর্যন্ত।

জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নানারকম দোকানপাট ও স্থাপনা মিলিয়ে প্রায় ৩৫০ অবৈধ স্থাপনা আছে পরীর পাহাড়ে।

“সরকারি এজেন্সিগুলো তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে এখানকার পরিস্থিতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সবাই যেন সতর্ক থাকে। পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে।”

পরীর পাহাড়ে আইনজীবীদের আরও দুটি ভবন

সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি, ক্ষোভ

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিকে এ সংক্রান্ত সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করে জেলা প্রশাসন।

এতে বলা হয়, ”ব্রিটিশ আমল থেকে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ও বিচারিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র পরীর পাহাড় ঐতিহ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

“ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ স্থাপনা, রাস্তার উপর পার্কিং, দোকান, হকার এসব কারণে পরীর পাহাড় সৌন্দর্য হারিয়ে ইট পাথরের জঞ্জালে পরিণত হয়েছে।“

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বিজ্ঞপ্তি আমরা কাউকে উদ্দেশ্যে করে দিইনি। ব্রিটিশরা পরিকল্পনা করে দুই তলা আদালত ভবন নির্মাণ করেছিল। তারা জানত এই পাহাড়ের ধারণক্ষমতা কত। এখন ধারণক্ষমতার তিনগুণ বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে পরীর পাহাড়ে।

“এখানে ভূমিকম্প, ভূমিধস বা অগ্নিকাণ্ডের মত কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। তাই সবাই যেন সচেতন থাকে। কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে যাতে কেউ দোষারোপ করতে না পারে সেজন্য সতর্ক করা হয়েছে।”

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “পরীর পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ স্থাপনা এসকল নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয়, কালেক্টর, সিডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর বা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা সংস্থার অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি।“

এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই আইনজীবীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি যে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন, তাহলে পরীর পাহাড়ের সব ভবনই তো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এখানে আদালতের একাধিক ভবন ও উনাদের প্রশাসনিক অনেক কার্যালয়ও আছে। আর কোনটি অবৈধ স্থাপনা তা প্রমাণ করুক।”

সবার সহযোগিতা পেলে ‘বেআইনি’ সবকিছুর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

পরীর পাহাড়ে অবস্থিত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত

পাঁচ ভবন আছে, আরও দুটি হবে

পরীর পাহাড়ে ওঠার পথে পুরাতন বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন লাগোয়া পথের পাশে আইনজীবী সমিতি ভবন। সেখানে পরপর এনেক্স-১, এনেক্স-২, শাপলা ও দোয়েল ভবন। পাঁচ ভবনের কোনোটিতে গাড়ি রাখার জায়গা নেই।

পাঁচ ভবনে মোট সাড়ে তিন হাজার আইনজীবীর চেম্বার। বর্তমানে সমিতির ভোটার পাঁচ হাজার। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন করে আরও দুটি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সমিতি।

এগুলোর নামকরণও করেছে সমিতি। মূল ভবনের পাশে ‘একুশে ভবন’ এবং শাপলা ভবনের পাশে প্রস্তাবিত ‘বঙ্গবন্ধু আইনজীবী ভবন’। ভবন দুটিতে মোট ছয়শ চেম্বার হবে। এ জন্য গত মাসে চেম্বার বরাদ্দ দিতে আবেদন আহ্বানও করা হয়েছে।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, “আমরা সরকার থেকে সত্তর দশকে এ জমি লিজ নিয়েছিলাম। লিজ চুক্তি আছে। পরে একটি মামলা করলে আমাদের সম্পত্তি কী পরিমাণ তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো আবেদন করেনি।”

এর আগে আদালত এলাকায় স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের সামনের চত্বরে ২ আগস্ট সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু করে জেলা প্রশাসন। সেখানে মাটি খোঁড়া হলে তা ২৫ অগাস্ট ভরাট করে দেন আইনজীবীরা।

সেখানে ‘গাড়ি রাখার স্থান’ সংবলিত ব্যানারও টানিয়ে দেওয়া হয় সমিতির পক্ষে। স্থানটিতে সরকারি কর্মকর্তা ও আইনজীবীরা গাড়ি রাখেন। এ নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধ শুরু।

জিয়া উদ্দিন বলেন, “সবাই গাড়ি রাখেন সেখানে দেয়াল ও গেট দিয়ে শুধু তাদের গাড়ি রাখার জন্য করতে চেয়েছিল। দেড়শ বছর ধরে আমরা ব্যবহার করেছি। প্রতিবাদ করেছি, তাতে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এসব করছেন।”