কাটা হচ্ছে পাহাড়ের গোড়া, যেন বর্ষায় ধসে পড়ে

চট্টগ্রাম নগরীর শিল্প জোন হিসেবে পরিচিত বায়েজিদ এলাকা একসময় ছিল পাহাড় ঘেরা। সেখানে এখন অবাধে চলছে পাহাড় কাটা, গড়ে উঠছে বসতি।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2021, 04:25 PM
Updated : 2 August 2021, 04:26 PM

কাটা পাহাড়ে শুরুতে নিম্ন আয়ের লোকজনদের থাকার ব্যবস্থা করা হলেও তা স্থায়ী হওয়ার পর এসব স্থানে এখন বহুতল ভবনও গড়ে ‍উঠছে।

বায়েজিদ টেক্সটাইল মোড় থেকে পশ্চিম দিকে দুই কিলোমিটার গেলেই চন্দ্রনগর। তার দক্ষিণ পাশে চৌধুরী নগর। অতীতে পাহাড় থাকলেও এখন সেখানে গড়ে উঠেছে বসতি।

এরপরও থেমে নেই সেখানে পাহাড় কাটা। নতুন নতুন পাহাড় কাটা হচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নতুন কৌশলে পাহাড় কাটা হচ্ছে এখন সেখানে। পাহাড়ের নিচে কিছুটা মাটি কাটা হয় বর্ষার শুরুতে, যাতে প্রবল বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়ে। ফলে পুরো দোষটি প্রকৃতির উপর দিয়ে যায়। আবার খরচও বেঁচে যায়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এভাবে পুরো পাহাড় ধসে পড়তে পড়তে একসময় সমতল হয়ে যায়। তখন ঘর তোলা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-আমীনের চোখেও ধরা পড়েছে পাড়ার কাটার নতুন এই কৌশল।

তিনি বলেন, “তারা অল্প অল্প করে কেটে রাখছে বৃষ্টির আগে। সঙ্গে সেখানে করা হচ্ছে কলাবাগান। বৃষ্টি এবং কলাবাগানের কারণে দ্রুত পাহাড় ধস হচ্ছে। এতে অসাধু ব্যক্তিরা অল্প খরচে পাহাড় সমতল করে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে।”

চট্টগ্রামের বায়েজিদ চন্দ্রনগরের নাগ-নাগিনী পাহাড়ের নিচ থেকে কেটে রাখা হয়েছে, যাতে অতিবৃষ্টিতে সহজেই ধসে পড়ে মাটি। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

চট্টগ্রাম নগরীর বালি মাটির পাহাড়গুলো দিনে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই ধসে পড়তে শুরু করে। বৃষ্টির পানিতেই ধুয়ে যায় ধসে পড়া পাহাড়ের মাটি।

“এভাবে পাহাড়গুলো কেটে সমতল করে ফেলা হচ্ছে,” বলেন পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের পরিদর্শক মো. মনির হোসাইন।

বায়েজিদে কাটা পাহাড় ও ধসে পড়ার চিত্র দেখা গেলেও পাহাড় কাটছে যারা, তাদের দেখা পাওয়া যায়নি।

বায়েজিদ চৌধুরী নগরে হুদা সাহেব কলোনির পেছনের পাহাড়টি স্থানীয়ভাবে পরিচিত রেলওয়ে পাহাড় নামে। এর থলিতে (কাটা অংশে) একটি টিনের ঘরে থাকেন হালিমা বেগম নামে এক নারী। ঘরের আশেপাশে করা হয়েছে কলাসহ বিভিন্ন সবজি বাগান। ঘরের সামনে ধসে পড়েছে পাহাড়ের মাটি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হালিমা জানান, অক্সিজেন এলাকার রুবেল নামে এক ব্যক্তি তাকে সেখানে থাকার জন্য দিয়েছে।

পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি করা হলেও সেখানে আছে বিদ্যুতের লাইন।

ওই পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দা আরেক নারী বকুল জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে বাস করেন তিনি। স্থানীয় শহীদ মাস্টার নামে এক ব্যক্তিকে তিনি প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা করে ভাড়া দেন। 

কে বা কারা পাহাড় কাটছে, সে বিষয়ে কিছু বলেতে রাজি হননি হালিমা ও বকুল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই পাহাড়গুলোর নিয়ন্ত্রণে আছেন শহীদ মাস্টারের পাশাপাশি ইব্রাহীম ও রুবেল নামে আরও দুজন। যারা বায়েজিদ বোস্তামী থানার সাবেক এক উপ-পরিদর্শকের হয়ে পাহাড় কাটার কাজ করছেন। 

বিভিন্ন পেশার লোকজনের দখলে থাকা চৌধুরী নগর এলাকার এসব পাহাড় বৃষ্টির আগে অল্প করে কেটে রাখা হয়েছিল। যাতে বেশি বৃষ্টিতে সহজেই ধসে পড়ে পাহাড়ি মাটি। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

চৌধুরী নগর পাহাড়ে কথা হয় মো. জাহিদ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে।

তিনি বলেন, ওই জায়গাটি ৪০১৪ নামে পরিচিত। ইলিয়াছ ও শাহজাহান নামে দুই ব্যক্তি খরিদসূত্রে এ পাহাড়ের মালিক। তাদের হয়ে পাহাড় দেখভালের কাজ করেন তিনি।

পাহাড়ে তিনি ছাড়াও আরও চারটি পরিবার ভাড়ায় থাকেন বলে জানান জাহিদ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মনির বলেন, “বর্তমানে এসব পাহাড়ে যারা বসবাস করেন, তারা সবাই তৃতীয় পক্ষ। তাদের কেউ ভাড়াটিয়া আবার কাউকে দেখাশোনার জন্য রাখা হয়েছে।”

অভিযান হয়, হোতারা ধরা পড়ে না

সোমবার চৌধুরী নগর পাহাড়ে অভিযানে যায় পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের একটি দল।

পাহাড় কাটার প্রমাণ পেয়ে সাতটি নোটিসের মাধ্যমে ১০ জনকে কার্যালয়ে শুনানির জন্য তলব করে।

শুনানির জন্য তলব করা হলেও মূল মালিকরা বেশির ভাগ সময়ই শুনানিতে আসে না বলে জানান অভিযানের নেতৃত্বে থাকা পরিদর্শক মনির।

তিনি বলেন, “পাহাড়ের মালিকদের খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। তারা সবসময় আড়ালে থেকে কিছু লোকজনকে পাহাড় কাটার দায়িত্ব দেয়। এরাই আবার অন্য লোকজনকে সেসব পাহাড়ে বসবাস করতে দেয়। যার কারণে বসবাসকারীরা পাহাড়ের মালিককে চেনেন না।” 

চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় অবাধে পাহাড় কেটে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলছে অবৈধ বসতি। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

মনির জানান, শুনানিতে অংশ না নিলে তাদের পুনরায় নোটিস দেওয়া হয়। তাতেও সাড়া না দিলে, নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করে মামলা করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চৌধুরী নগর পাহাড়ের একটি অংশ ইসমাইল হুজুর নামে পরিচিত এক ব্যক্তির দখলে আছে। সেখানে তিনি পাহাড় কেটে গড়ে তুলেছেন মাদ্রাসা ও এতিমখানা। যার জন্য তাকে দুই লাখ জরিমানাও করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

এছাড়া একটি শিল্প গ্রুপ, বায়েজিদ বোস্তামী থানার সাবেক এক ওসি, দু’জন এসআই, দুই এএসআই, এক আইনজীবী সেখানে বিভিন্ন পাহাড়ের দখলে আছেন। তাদের হয়ে স্থানীয় কিছু লোক এসব পাহাড় কাটার কাজ করে।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ চন্দ্রনগরের নাগ-নাগিনী পাহাড় অবাধে কেটে সমান্তরাল করা হচ্ছে। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

অন্যদিকে বায়েজিদের চন্দ্রনগর এলাকার ‘নাগ-নাগিন’ পাহাড় কাটা হচ্ছে খাড়াভাবে। সেখান থেকে ধসে পড়ছে মাটি। তার আশে পাশে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন।

স্থানীয়রা জানান, গত কয়দিনের টানা ভারি বৃষ্টিতে পাহাড় থেকে বেশকিছু মাটি ধসে পড়েছে। সামনে আবার বেশি বৃষ্টি হলে বড় ধরণের ধসের শঙ্কা তাদের।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় অবাধে পাহাড় কেটে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলছে অবৈধ বসতি। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

বেড়েছে তাপমাত্রা

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-আমীন বলেন, বায়েজিদ এলাকায় এক সময় ছিল পাহাড় ও ঘন জঙ্গল। পরবর্তীকালে সেখানে শিল্পাঞ্চল করায় তার রূপ পরিবর্তন হতে শুরু করে।

একে একে গড়ে উঠছে বিভিন্ন শিল্পকারখানা, সেগুলোকে কেন্দ্র করে হচ্ছে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা। তার উপর বায়েজিদ লিঙ্ক রোড এলাকায় পরিবেশের আরও একটি সমস্যা হয়েছে।

বায়েজিদ থেকে ভাটিয়ারি পর্যন্ত বায়েজিদ লিংক রোড নির্মাণে সিডিএ প্রায় ১৮টি পাহাড় কাটে। সম্প্রতি সড়কের পাশের কাটা পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে।

নিজে গবেষণা চালিয়ে অধ্যাপক আল-আমীন দেখেছেন, শিল্পাঞ্চল হওয়ার পর বায়েজিদ এলাকার তাপমাত্রা নগরীর অন্যান্য এলাকার চেয়েও কয়েক ডিগ্রি বেশি থাকে।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকার পাহাড় ছিল জঙ্গলে ঘেরা, অবৈধ দখলদারের সেই পাহাড় কেটে বসতি গড়ায় এখন আর গাছ-পালা নেই সেখানে। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

তিনি বলেন, “যে এলাকায় আরও বেশি বনায়ন করা দরকার, সেখানে প্রতিনিয়ত পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের জীব বৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে।”

শিল্প কারখানা ও রাস্তা তৈরি যেমন প্রয়োজন, তার আশেপাশের পরিবেশ ঠিক রাখাও তেমন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।