মিনুকে জেলে পাঠাতে ‘দেড় লাখ টাকায় চুক্তি’, জড়িত আরও ২

নিজের পরিবর্তে মিনু আক্তারকে সাজা খাটাতে দেড় লাখ টাকায় দুই ব্যক্তির সঙ্গে রফা করেছিলেন কুলসুম বেগম কুলসুমী। তবে পরে সেই টাকা দিতে না পেরে গিয়েছিলেন আত্মগোপনে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2021, 03:09 PM
Updated : 1 August 2021, 03:10 PM

ওই দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার এবং আদালতে কুলসুমী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর পর এই তথ্য জানিয়েছে চট্টগ্রাম পুলিশ।

এদিকে কারামুক্ত মিনু গত ২৮ জুন গভীর রাতে বায়েজিদ লিংক রোডে ‘ট্রাকচাপায়’ মারা গিয়েছিলেন বলে তখন জানালেও পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ দেখার পর বলছে, সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা চাপা দিয়েছিলেন অন্যের হয়ে জেলখাটা এই নারীকে।

মিনুকে সাজা খাটানোর ঘটনায় পুলিশ শনিবার শাহাদাত হোসেন (৪২) এবং শুক্রবার নুর আলম কাওয়াল (৪৮) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে ২৯ ‍জুলাই কুলসুমী ও মর্জিনা আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নুর আলম কাওয়াল ও শাহাদাত হোসেন।

শাহাদাত জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল এলাকার বেলায়েত হোসেনের ছেলে এবং নুর আলম কাওয়াল একই এলাকার মৃত আলী হোসেন মোল্লার ছেলে। পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা ছিন্নমূল এলাকায় তারা দুজন প্রভাবশালী বলে পুলিশ জানায়। মিনু ওই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।

কোতোয়ালি থানার ওসি মো. নেজাম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুলসুমীকে জিজ্ঞাসাবাদে ও নুর কাওয়ালের দেওয়া তথ্যে শাহাদাতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শাহাদাতকেও একদিনের রিমান্ডে পেয়েছি আজ।”

এর আগে কুলসুমী ও তার সহযোগী মর্জিনা বেগমকে হেফাজতে পেয়েছিল পুলিশ। কুলসুমীর একটি হত্যামামলায় যাবজ্জীবন সাজার রায় হয়েছিল।

ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, “যাবজ্জীবন সাজার আদেশ হলে সাজা থেকে বাঁচার জন্য ছিন্নমূলের বাসিন্দা মর্জিনার সহযোগিতা চায় কুলসুমী। তখন মর্জিনা শাহাদাতের সাথে ও পরে শাহাদাত গিয়ে নুর আলম কাওয়ালের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করে।

“নুর আলম কাওয়াল ও শাহাদাত দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে কুলসুমীর পরিবর্তে অন্য একজনকে জেলে পাঠাবে বলে জানালে তাতে রাজি হয় কুলসুমী।”

ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, “মিনু আক্তারকে টাকা দেবে বলে লোভ দেখায় এবং এক মাসের মধ্যে জামিন করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয় মর্জিনা। ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনুকে কুলসুমী সাজিয়ে মর্জিনা বেগম ও শাহাদাত আদালতে নিয়ে যায়। এবং সেখানে মিনু নিজেকে কুলসুমী পরিচয় দিয়ে হাজতে যায়।”

কুলসুমীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, চুক্তি মতো দেড় লাখ টাকা দিতে না পারায় শাহাদাত ও নুর আলম তাকে চাপ দিতে থাকে। এনিয়ে স্থানীয়ভাবে সালিশও হয়। পরে কুলসুমী ও মর্জিনা ইপিজেড এলাকায় আত্মগোপন করে। তখন শাহাদাত ও নুর আলম ছিন্নমূল এলাকায় কুলসুমী ও মর্জিনার দুটি জমি দখল করে নেন।

রোববার চট্টগ্রামের মহানগর হাকিম শফি উদ্দিন আহমেদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন কুলসুমী।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে কুলসুমী জানান, হত্যা মামলায় এক বছর চার মাস হাজতবাসের পর জামিনে বেরিয়ে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা হলে তিনি পলাতক হন।

মোবাইল ফোন নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় পোশাককর্মী পারভিনকে গলাটিপে হত্যার পর একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

কুলসুম আক্তার কুলসুমী

ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ওই বছরের ২৬ অক্টোবর কুলসুমীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কুলসুমীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুলসুমী জামিনে বের হয়। তার প্রায় আট বছর পর কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে চট্টগ্রামের জজ আদালতে রায় হয়।

রায়ের সময় কুলসুমী ছিলেন পলাতক। পরের বছর ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুমী সেজে মিনু আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এরমধ্যেই ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল কুলসুমী রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করেন। এদিকে গত ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর চতুর্থ দায়রা জজ আদালতকে চিঠি দিয়ে জানায়, কারাগারে থাকা নারী দণ্ডিত কুলসুমী নন।

পরদিন তলব করা হলে মিনু আদালতে এসে জানান, কুলসুমীকে তিনি চেনেন না। ‘সন্তানদের জন্য খাবার দেবে’ বলে মর্জিনা তাকে জেলে ঢুকায়।

ঘটনাট শুনে ৭ জুন মিনুর মুক্তির আদেশ দেয় উচ্চ আদালত।

‘মিনুর মৃত্যুর অটোরিকশা চাপায়’

কুলসুমীর হয়ে সাজা খাটা মিনু চলতি বছরের ১৬ জুন মুক্তি পান। এর ১৩ দিনের মাথায় গভীর রাতে বায়েজিদ লিংক রোডে গাড়িচাপায় তার মৃত্যু হয়।

সন্তানদের ভরণ-পোষণের ‘মিথ্যা আশ্বাসে’ অন্যের হয়ে সাজা ভোগ করা মিনু আক্তার উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিন বছর পর বুধবার চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান। ছবি: সুমন বাবু

৩ জুলাই মিনুর পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশ। তার আগেই ঘটনার পরদিন বেওয়ারিশ হিসেবে মিনুর দাফন হয়।

তখন পুলিশ বলেছিল ‘ট্রাকচাপায়’ মিনুর মৃত্যু হয়েছে।

রোববার বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হয়েছি, একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা মিনুকে চাপা দেয়। তবে এখনও অটোরিকশাটিকে শনাক্ত করা বা এ সংক্রান্ত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।”

মুক্তির পর মিনুর মৃত্যুর ঘটনাকে ‘অস্বাভাবিক’ উল্লেখ করে তা তদন্তের দাবি জানান তার আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ ও ভাই রুবেল হোসেন।

কুমিল্লার ময়নামতি এলাকার বাসিন্দা মিনুর স্বামী ঠেলাগাড়িচালক বাবুল বছর পাঁচেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর মিনু সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকায় আসেন।

মিনু জেলে থাকার সময় তার দুই ছেলে ইয়াছিন (১০) ও গোলাপ (৭) সীতাকুণ্ডের একটি এতিমখানায় ছিল এবং মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসকে (৫) স্থানীয় এক ব্যক্তি লালন পালন করছিল।

কিন্তু গত এপ্রিলে রোজার মধ্যে মিনুর মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস দুর্ঘটনায় মারা যান। জেল থেকে বের হওয়ার পর মেয়ের মৃত্যুর খবর পান মিনু।