অন্যকে দিয়ে সাজা খাটানো কুলসুমী ও মর্জিনা রিমান্ডে

হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা অন্য নারীকে দিয়ে খাটানো কুলসুম আক্তার কুলসুমী ও তার সহযোগী মর্জিনা আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2021, 03:56 PM
Updated : 29 July 2021, 03:56 PM

পুলিশ বলছে, অর্থ সহায়তা ও সন্তানদের ভরণ পোষণ দেওয়ার আশ্বাসে বিধবা মিনু আক্তারকে সাজা খাটতে রাজি করিয়েছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন মর্জিনা আক্তার।

প্ররোচনা দিয়ে মিনুকে হাজতবাসে রাজি করানোয় প্রতারণার অভিযোগে কুলসুমী ও মর্জিনাসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের বিরুদ্ধে পুলিশের করা মামলায় তাদের রিমান্ডের আদেশ পাঠিয়েছে আদালত।

গ্রেপ্তার কুলসুম আক্তার কুলসুমী (৪৫) লোহাগাড়া উপজেলার মাঝের পাড়া গোরস্থান গ্রামের আনু মিয়ার মেয়ে। নগরীর কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি বাসায় তিনি ভাড়া থাকেন।

আর তার সহযোগী মর্জিনা আক্তার (৩০) নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার ছিন্নমুল এলাকার বাসিন্দা।

বুধবার গভীর রাতে নগরীর ইপিজেড থানাধীন ২ নম্বর মাইলের মাথা কমিশনার গলি থেকে কুলসুমীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে সহযোগিতা করায় মর্জিনা আক্তারকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিনু আক্তারকে দণ্ডপ্রাপ্ত কুলসুমীর হয়ে সাজা খাটাতে রাজি করানোর বিষয়ে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মর্জিনা।”

তাদের দুজনকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে বিচারক দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন বলে জানান ওসি।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তির ১৩ দিনের মাথায় ট্রাকচাপায় মিনুর মৃত্যুর সঙ্গে কুলসুমী বা মর্জিনার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কিনা জানতে চাইলে ওসি নেজাম বলেন, “সে বিষয়ে এখনো জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ হয়নি।”

মিনু ২৮ জুন মারা গেলেও তার পরিচয় নিশ্চিত হয় ৩ জুলাই। এরপর ওই ঘটনায় পুলিশ একটি মামলা করেছিল। 

এছাড়া উচ্চ আদালত মিনুকে মুক্তির আদেশ দেওয়ার পর চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ পলাতক কুলসুমীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল।

মিনু আক্তারের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আশা করি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মিনুকে সাজা খাটানো এবং তার মৃত্যুর বিষয়ে কারো সম্পৃক্ততা আছে কিনা সেসব তথ্য উঠে আসবে।”

মোবাইল ফোন নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় পারভিন নামের এক পোশাককর্মীকে গলাটিপে হত্যার পর সেখানকার একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

সেসময় পারভিন আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেন কুলসুমী। ওই ঘটনায় শুরুতে অপমৃত্যু মামলা হলেও পরে পুলিশ তদন্তে প্রমাণ পেয়ে হত্যা মামলা করে।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই বছরের ২৬ অক্টোবর কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৩১ অক্টোবর রিমান্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

এক বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকার পর ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুলসুমী জামিনে বেরিয়ে আসেন। তার জামিন পাওয়ার প্রায় আট বছর পর ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত ওই মামলার রায় দেয়।

রায়ে কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ের দিন অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে সাজা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

এরপর ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুমী ‘সেজে’ মিনু আক্তার সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

কুমিল্লার ময়নামতি এলাকার বাসিন্দা মিনুর স্বামী ঠেলাগাড়ি চালক বাবুল বছর পাঁচেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর তিনি সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকায় থাকছিলেন তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে।

মিনু কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল কুলসুমী রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করেন। ৩০ এপ্রিল হাই কোর্ট আপিল গ্রহণ করে। পরে দণ্ডিত কুলসুমী জামিন আবেদন করলে চলতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্ট তা বাতিল করে দেয়।

এদিকে গত ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর চতুর্থ দায়রা জজ আদালতকে চিঠি দিয়ে জানায়, কারাগারে থাকা নারী দণ্ডিত কুলসুমী নন।

পরদিন কারাগারে থাকা মিনু আক্তারকে আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে তিনি জবানবন্দি দেন।

মিনু বলেছিলেন, মর্জিনা নামের এক নারী সন্তানদের ভরণ-পোষণের আশ্বাসে তাকে জেল খাটতে রাজি করান। কিন্তু আশ্বাস মতে কোনো টাকা বা সন্তানদের জন্য খাবার কিছুই দেওয়া হয়নি। প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তারকে তিনি চেনেন না।

আদালত তখন কারাগারের নিবন্ধন দেখে আসামি কুলসুমী ও সাজাভোগকারীর মধ্যে অমিল খুঁজে পান। বিচারক সেসব নথি হাই কোর্টে পাঠান।

ওই ঘটনা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে আইনজীবী মো. শিশির মনির তা আপিল সংশ্লিষ্ট হাই কোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন। শুনানি শেষে ৭ জুন মিনুর মুক্তির আদেশ দেয় উচ্চ আদালত।

উচ্চ আদালতের সেই আদেশ চট্টগ্রামে এসে পৌঁছালে ১৬ জুন মুক্তি পান মিনু আক্তার। তার আগেই গত এপ্রিলে রোজার মধ্যে দুর্ঘটনায় মারা যায় মিনুর ছোট মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস। জেল থেকে বের হওয়ার পর মেয়ের মৃত্যুর খবর পান মিনু।

মুক্তির ১৩ দিনের মাথায় ২৮ জুন গভীর রাতে বায়েজিদ লিংক রোডে ‘ট্রাকচাপায়’ মিনু মারা যান বলে জানায় পুলিশ। পরদিন বেওয়ারিশ হিসেবে তার লাশ দাফন করে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম।

মিনুর মৃত্যুর ঘটনাকে ‘অস্বাভাবিক’ উল্লেখ করে সে সময় তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন তার আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ।

আরও পড়ুন