সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প, বিরোধিতা নানা প্রশ্নে

পূর্ব রেলের সদর দপ্তর চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) একটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 July 2021, 05:45 PM
Updated : 12 July 2021, 05:53 PM

প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক কারণে সেখানে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলন বা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে তারা বাধ্য হবে।

রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারী নেতাদের দাবি, গুরুত্বপূর্ণ সিআরবি ভবনের পাশে এবং রেল কর্মচারীদের কোয়ার্টার সরিয়ে হাসপাতাল করা হলে রেলের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে।

তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি, সিআরবির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত যে অংশে শতবর্ষী গাছ, শিরিষ তলা, সেখানে হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে না। হাসপাতালের জন্য নির্ধারণ করা স্থানে কেবল একটি শতবর্ষী গাছ আছে, যা রক্ষা করা হবে।

অবিভক্ত ভারতের বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ের সদর দপ্তর সিআরবি ভবনটি হয় ১৮৯৫ সালে। শতবর্ষী বৃক্ষ ঘেরা পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা ঘেরা এ এলাকাটি জনসমাগমের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। আশেপাশের পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণির আবাস।

গত কয়েক বছর ধরে ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় পহেলা বৈশাখসহ নানা আয়োজন হয় সিআরবি শিরীষ তলায়। ছায়াঘেরা পরিবেশ নগরবাসীর প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণ এবং বিনোদনের কেন্দ্রও এই স্থানটি।

কোথায় কীভাবে হবে হাসপাতাল

নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের সড়ক ধরে কদমতলীর দিকে এগিয়ে গেলে পাহাড়ে ঘেরা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি)।

সড়কের ডান পাশে পাহাড়ের ওপর সিআরবি ভবন। আর বাম পাশে বর্তমান রেলওয়ে হাসপাতাল। সিআরবি ভবনের সামনের মোড়টি সিআরবি সাত রাস্তার মোড় নামে পরিচিত। এখান থেকে সাতটি ছোট বড় রাস্তা বিভিন্ন দিকে চলে গেছে।

সিআরবি মোড় থেকে টাইগার পাস, কদমতলী ও জিএম বাংলোমুখী সড়কগুলোর দুপাশে আছে শতবর্ষী রেইন ট্রি ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। টাইগারপাস ও জিএম বাংলোমুখী সড়কের মাঝে বড় মাঠে থাকা শিরীষ গাছের তলায় প্রতি বছর হয় বর্ষবরণের অনুষ্ঠান।

সড়কের বাম পাশে বর্তমান রেলওয়ে হাসপাতাল, পাশের খালি জমি, রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি রোড এবং এই রাস্তাটির দুপাশে থাকা প্রায় ৫০টি কর্মচারী কোয়ার্টার (একতলা সেমিপাকা) নিয়ে মোট ছয় একর জমিতে হাসপাতালটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) সভায় প্রকল্পটি পিপিপিতে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পিপিপি প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় সিসিইএ সভায়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।

এরপর গত বছরের ১৮ মার্চ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সাথে সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তারপর চলতি বছরের শুরুতে নির্ধারিত জমির সামনে প্রকল্পের একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়।

এই প্রকল্পের পরিকল্পনা ও সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপি)। কার্যনির্বাহী সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করবে ইউনাইটেড চট্টগ্রাম হাসপাতাল লিমিটেড।

প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১২ বছর। প্রকল্পের আওতায় ১০০ আসনের একটি মেডিকেল কলেজ, ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং দুই ধাপে মোট ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। এতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ হবে। ৫০ বছর পর প্রকল্পের মালিকানা হবে রেলওয়ের।

ইতোমধ্যে প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট এবং প্রিমিয়াম বাবদ রেলওয়েকে প্রায় আট কোটি টাকা পরিশোধও করেছে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ব্রিজ) আহসান জাবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছরের মার্চে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও করোনা সংক্রমণের কারণে কাজ আগায়নি। সম্প্রতি তারা আমাদের ডিটেইল ডিজাইন সাবমিট করেছে। এখন সিডিএর অনুমোদনের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র লাগবে।

“এনভায়রনমেন্ট ইমপেক্ট এসেসমেন্ট প্রতিবেদন পেলে সিডিএতে আবেদন করবে। এরমধ্যে ফিজিক্যাল ওয়ার্ক করার কথা ছিল। করোনার কারণে সম্ভব হয়নি।”

চুক্তি অনুসারে, চুক্তি স্বাক্ষরের তিন বছর পর প্রথম বার্ষিক ফি হিসেবে রেলওয়ে পাবে ৭৫ লাখ টাকা। চতুর্থ বছরে ৭৫ লাখ টাকা। পঞ্চম ও ষষ্ঠ বছরে দেড় কোটি টাকা করে। পরবর্তী সময়ে চুক্তির মেয়াদকাল পর্যন্ত তিন বছর পরপর ১০ শতাংশ হারে ফি বাড়বে।

রেলের জমি, অন্যের হাসপাতাল

সম্প্রতি রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনির ১৫-২০টি বাসা ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় থাকা বাকি বাসাগুলোও সরানোর প্রক্রিয়া চলছে।

এরপর ক্ষুব্ধ রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন পূর্ব রেলের সদর দপ্তর এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধ চেয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দেয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে প্রকল্প নেওয়ার আগে রেলের শ্রমিক কর্মচারীদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। এ জমিটি কীভাবে নির্ধারণ করা হল?

“হাসপাতালে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। হাসপাতাল করতে চাইলে রেলের অনেক অব্যবহৃত জমি আছে। কুমিরা রেলওয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ৩৫ একর জমি আছে। সেখানেও করতে পারে।”

প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় একটি শতবর্ষী রেইনট্রি ছাড়াও কিছু বড় গাছ আছে। এছাড়া রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনিতে একটি শহীদ মিনার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ নজির আহম্মদের কবর আছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়কারী মোখলেসুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পূর্ব রেলের সদর দপ্তর সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এছাড়া এখানে স্টাফ কোয়ার্টার আছে। এখানে কারা হাসপাতালের প্রস্তাব করলেন?

“যারা তা করেছেন তারা রেলের স্বার্থবিরোধী। তাদের দ্বারা রেলের উন্নতি সম্ভব না। এখানে গাছ কাটা পড়বে। হাসপাতাল ও কলেজ ঘিরে বাণিজ্যিক কর্মকণ্ডে সিআরবির প্রকৃতি ও বর্তমান পরিবেশ বদলে যাবে। রেলের অনেক জমি আছে, হাসপাতাল অন্য কোথাও হোক।”

প্রকল্প পরিচালক রেল কর্মকর্তা আহসান জাবির বলেন, “কিছু কোয়ার্টার ইতিমধ্যে সরানো হয়েছে। তাদের অন্যত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। প্রকল্পের প্রথম ফেজে শহীদ মিনার পর্যন্ত যাবে না। এখন যেটুকু জায়গা লাগবে সেটুকুই নেওয়া হবে।”

প্রকৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার দাবি

সোমবার চট্টগ্রামের ১৭ জন জ্যেষ্ঠ নাগরিক এক বিবৃতিতে ‘নগরীর ফুসফুস’ সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ না করার দাবি জানান।

বিবৃতিদাতারা হলেন- শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী, ড. অনুপম সেন, ড. মু সিকান্দার খান, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক, অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, অধ্যাপক আবুল মনসুর, কবি-সাংবাদিক আবুল মোমেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, ডা. এ. কিউএম সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক হরিশংকর জলদাস, অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলীম, ডা. চন্দন দাশ, নাট্যব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দার, অধ্যাপক অলক রায়, স্থপতি জেরিনা হোসেন, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার ও আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান।

বিবৃতিতে বলা হয়, “ঐতিহ্যবাহী সিআরবি-সাত রাস্তার মোড় এলাকায় বেসরকারি সংস্থার বহুতল হাসপাতাল নির্মাণের খবর চট্টগ্রামের আপামর মানুষকে অত্যন্ত ব্যথিত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ করেছে।

“সিআরবি, সাত রাস্তার মোড় ও টাইগার পাস ঘিরে থাকা পাহাড় ও উপত্যকায় গাছপালামণ্ডিত এলাকাটি চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবেই গণ্য। হাসপাতালের কারণে জন সমাগম বৃদ্ধি ও ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সিআরবি এলাকার নির্জনতা ও পরিবেশ ঝুঁকিতে ফেলবে।”

ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, “ওই এলাকায় ১৯৩০ সনের চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহীরা অর্থসংগ্রহের জন্যে অভিযান চালিয়েছিল। এছাড়া সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ বা কলোনিয়াল স্থাপত্যের বিলীয়মান নিদর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপত্যকলা। ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষকের শিক্ষা ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।”

এসব বিবেচনা থেকেই এলাকাটিকে বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের ২য় ভাগের ২৪ ধারা অনুযায়ী ঐতিহ্য ভবন ঘোষণা করে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধী নই। কেবল প্রাকৃতিক কারণে সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্থানে এধরনের একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ অনুচিত বলে মনে করছি। চট্টগ্রামে আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন আছে, তবে তা উপযুক্ত স্থানেই নির্মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।”

অবিলম্বে এই ‘হঠকারী সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ’ থেকে সরে না আসলে নাগরিক সমাজ বৃহত্তর আন্দোলন ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন বিবৃতিদাতারা।

সোমবার পৃথক বিবৃতিতে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নেতৃবৃন্দ সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে।

ক্যাবের বিবৃতিতে বলা হয়, “নগরীর লক্ষ মানুষের উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিসর এবং চট্টগ্রামের ইতিহাসের অংশ সিআরবিতে শতবর্ষী গাছ ও প্রকৃতি ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন দুঃখজনক।”

শনিবার সিআরবি রক্ষার দাবি জানিয়ে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন এক বিবৃতিতে বলেন, রেলের বহু জমি অবৈধ দখলে। তা উদ্ধার করে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করলে চট্টগ্রামবাসীর আপত্তি থাকবে না।

ঐতিহাসিক সিআরবি ও শতবর্ষী বৃক্ষ রক্ষায় চট্টগ্রামের সব শ্রেণি পেশার মানুষের পাশে থাকার ঘোষণাও দেন সুজন।

প্রকল্প পরিচালক রেল কর্মকর্তা আহসান জাবির বলেন, “যেভাবে বিভিন্ন স্থানে বলা হচ্ছে গাছ কেটে বা প্রকৃতি নষ্ট করে প্রকল্প হবে তা সঠিক নয়। প্রকল্প এলাকায় একটি শতবর্ষী গাছ আছে সেটি রক্ষা করা হবে। সেভাবেই প্ল্যানিং হয়েছে।  

“সত্যিকারের অবস্থানটা জানা প্রয়োজন। তা না হলে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। সিআরবির যে অংশের ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে হাসপাতাল হবে, সেখানে আসলে হাসপাতাল হবে না। যে জমিটিতে প্রকল্প হবে সেখানে কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজন হয় না। এর বেশ কিছু অংশে এখনও নানা স্থাপনা আছে।”