অন্যের হয়ে জেল খাটা সেই মিনু আক্তারের মৃত্যু হল ‘ট্রাকচাপায়’

সন্তানদের ভরণ-পোষণের ‘মিথ্যা আশ্বাসে’ অন্যের হয়ে তিন বছর জেল খাটা মিনু আক্তার কারামুক্তির ১৩ দিনের মাথায় ‘ট্রাকচাপায়’ মারা গেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2021, 08:37 AM
Updated : 4 July 2021, 08:37 AM

বায়েজিদ থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান বিডিনিউজ জানান, গত ২৮ জুন রাত সাড়ে ৩টার দিকে চট্টগ্রামের বায়েজিদ লিংক রোডে ট্রাকের চাপায় এক নারীর মৃত্যুর পর আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ হিসেবে তার লাশ দাফন করে। শনিবার পুলিশ নিশ্চিত হয়, নিহত ওই নারী ছিলেন মিনু আক্তার।

তার আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বলছেন, এই মৃত্যু ‘অস্বাভাবিক’। মৃত্যুর কারণ জানতে তারা আদালতের দারস্থ হবেন।

অন্যদিকে পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলের সেই রাতের সিসিটিভি ভিডিও তারা খতিয়ে দেখছে। সেখানে রাস্তায় মিনুকে ‘অস্বাভাবিকভাবে’ হাঁটতে দেখা যায়। ট্রাকের নিচে চাপা পড়ার আগে সড়কে দায়িত্বরত টহল পুলিশের সদস্যরা তাকে দুইবার সড়ক থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।

ত্রিশোর্ধ মিনুর বাড়ি কুমিল্লার ময়নামতি এলাকায়। স্বামী ঠেলাগাড়ি চালক বাবুল বছর পাঁচেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকায় থাকছিলেন মিনু।

সন্তানদের খাওয়া-দাওয়া এবং আর্থিক কিছু সহায়তার প্রতিশ্রুতিতে কুলসুমা আক্তার নামের এক নারীর কাছ থেকে বদলি জেল খাটার প্রস্তাব পেয়ে তিনি রাজি হন।

২০০৬ সালে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে এক নারীকে হত্যার দায়ে ২০১৭ সালে কুলসুমা আক্তারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। রায়ের সময় তিনি ছিলেন পলাতক।

পরে ২০১৮ সালের জুনে কুলসুমা আক্তার ‘সেজে’ মিনু আক্তার ‘স্বেচ্ছায়’ আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

প্রায় তিন বছর কারাগারে থাকার পর চলতি বছরের ১৮ মার্চ কারা কর্তৃপক্ষকে মিনু আক্তার জানান, তিনি কোনো মামলার আসামি নন। তার নাম কুলসুমাও নয়। সন্তানদের ভরণ-পোষণের আশ্বাস পেয়ে তিনি আরেকজনের বদলে জেল খাটতে রাজি হয়েছেন।

কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিষয়টি জানার পর চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ গত মার্চে মামলার নথিপত্র উচ্চ আদালতে পাঠান বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ১৬ জুন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান মিনু আক্তার।

তিনি জেলে যাওয়ার পর তার দুই ছেলে ইয়াছিন ও গোলাপ ছলিমপুরের একটি মাদ্রাসায় ছিল। আর সবার ছোট মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসকে লালন পালন করতেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। গত এপ্রিলে রোজার মধ্যে মেয়েটির মৃত্যু হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর মেয়ের মৃত্যুর খবর পান মিনু।

তার ভাই রুবেল হোসেন জানান, মুক্তি পাওয়ার পর ছেলেদের নিয়ে তার বাসাতেই ছিলেন মিনু। কিন্তু মেয়ের মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না, খুব কান্নাকাটি করতেন। গত ২৮ জুন সকালে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। পরের দুদিন তাকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও পাননি।

বায়েজিদ থানার ওসি কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্রাক চাপায় আহত হওয়ার পর ভোর ৫টার দিকে মারা যান মিনু। কিন্তু তার পরিচয় তখন জানা যায়নি। গতকাল উনার পরিচয় আমরা নিশ্চিত হয়েছি। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ নেওয়া হয়েছে। কোন গাড়ি তাকে চাপা দিয়েছে তা শনাক্তের চেষ্টা চলছে।”

ওসি বলেন, “ঘটনার রাতে সেখানকার টহল পুলিশ ২-৩ বার উনাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। তারপরও তিনি বারবার লাফিয়ে রাস্তায় নামছিলেন। উনার হাঁটাচলা স্বাভাবিক ছিল না।”

গত ১৬ জুন উচ্চ আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে মুক্তি পান মিনু আক্তার।

মিনুর আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বলেন, পুলিশ শনিবার জঙ্গল ছলিমপুরে গিয়ে ছবি দেখিয়ে মিনুর খোঁজ করে। সেখানকার লোকজন তাকে চিনতে পারে। পরে মিনুর ভাই রুবেল হোসেন ছবি দেখে শনাক্ত করেন।

“তিন বছর জেল খাটার পর মুক্তির অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এভাবে মৃত্যু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আমরা আদালতের কাছে আবেদন করব বিষয়টি তদন্তের জন্য।”

মিনুর ভাই রুবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়র পর থেকেই ওর আচরণ স্বাভাবিক ছিল না। কান্নাকাটি করত, মাঝে মাঝে আমার সাথে চিল্লাচিল্লিও করত। আলাদা বাসা ঠিক করে দিতে বলেছিল।

“সেদিন (২৮ জুন) আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। আগের রাতেও আলাদা বাসা ঠিক করে দিতে বলেছিল। আমি বলেছিলাম, কয়দিন পর ঠিক করে দেব।”

তিনি বলেন, শনিবার বায়েজিদ থানার এসআই খুরশিদ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার কাছেই ট্রাকচাপায় বোনের মৃত্যুর খবর পান।

“উনি বলেছেন, ২৮ জুন রাতে আমার বোনকে লিংক রোডের আরেফিন নগর অংশে পড়ে থাকা অবস্থায় পেয়েছে। পরে পুলিশ মেডিকেলে নিয়ে গেছিল। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম দাফন করেছে আরেফিন নগর কবরস্থানে।”

আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ জানান, মিনু যখন জেলে যান, তার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস তখন কোলের শিশু। গত রোজায় জঙ্গল ছলিমপুরের একটি পাহাড়ে শিশুদের সাথে খেলার সময় উপর থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায় মেয়েটি।

“মেয়েটিকে একবার জেলখানায় মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিন বছর পর মুক্তি পেয়ে মিনু আর মেয়েকে পায়নি।”