রোহিঙ্গা নুরকে এনআইডি: চট্টগ্রামে দুদকের মামলা

চট্টগ্রামে যুবলীগ নেতা ফারুক হত্যার আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত রোহিঙ্গা ‘ডাকাত’   জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার ঘটনায় সাবেক কাউন্সিলর ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2021, 02:45 PM
Updated : 15 June 2021, 02:45 PM

মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এ মামলাটি করেন কমিশনের উপ-পরিচালক সুভাষ চন্দ্র দত্ত। 

নুর আলমকে জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের চৌধুরী রাসেল ও একই ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারী ফরহাদ হোসাইনকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।

বাকি আসামিরা হলেন- চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানার সাবেক ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মোহাম্মদ শাহজামাল, পাঁচলাইশ নির্বাচন অফিসের প্রুফ রিডার উৎপল বড়ুয়া, রন্তু বড়ুয়া ও পাঁচলাইশ থানার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা ও বর্তমানে পাবনা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ।

২০১৯ সালের ৩১ অগাস্ট টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন স্থানীয় যুবলীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলার প্রধান আসামি নুর আলম ওরফে নুরু, যিনি ‘নুরু ডাকাত’ নামে টেকনাফে পরিচিত ছিলেন।

নুরুর মৃত্যুর পর তার কাছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্রের স্মার্ট কার্ড পাওয়ার ঘটনাটি আলোচনার জন্ম দেয়।

দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর উপ-পরিচালক লুৎফর কবির চন্দন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নুরু ডাকাতের স্মার্ট কার্ড পাওয়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশন বিভাগীয় তদন্ত করে। সেখানে তার তথ্য ফরমে বিভিন্ন গোঁজামিল পাওয়া যায়।”

পাশাপাশি নুরু ডাকাত চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের ঠাণ্ডাছড়িতে যে স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেছিলেন, সেটাও ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে বলে জানান তিনি।

চন্দন বলেন, নুর ও তার স্ত্রী নুর কাইয়াছ বেগমকে জন্মসনদ দেওয়া হয় চট্টগ্রামের ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হলিশহর ওয়ার্ড থেকে। ওই জন্ম সনদের মাধ্যমে তাকে ভোটার তালিকায় নিবন্ধন ও স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়। 

রোহিঙ্গা নারীর পরিচয়পত্র জালিয়াতির ঘটনায় মামলা

নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে এক রোহিঙ্গা নারীর ভুয়া জাতীয় পরিচয়ত্রের (এনআইডি) তথ্য মেলার পর সাবেক এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং এক সদস্যসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে।

মামলায় ওই নারীর জন্মসনদ প্রস্তুতকারীসহ নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের চার কর্মচারীকেও আসামি করা হয়েছে।

মঙ্গলবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এ মামলাটি করেন কমিশনের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, রমজান বিবি নামে এক রোহিঙ্গা নারী লাকী নাম নিয়ে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করান। ওই ভুয়া পরিচয়পত্রের তথ্যও নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে।

লাকী পরিচয় দেওয়া রমজান বিবি এবং তার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস হাটহাজারি উপজেলার ৩ নম্বর মীর্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয়তা সনদ নিয়েছিলেন।

পরে ২০১৯ সালের ১৮ অগাস্ট তারা চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসর্পোটের জন্য আবেদন করেন। ওই নারী জাতীয়তা সনদের পাশাপাশি তার জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও জমা দিয়েছিলেন আবেদনের সঙ্গে।

তাদের জাতীয়তা ও জন্মসনদ প্রদান ও যাচাই বাছাইয়ে জড়িত ছিলেন ৩ নম্বর মীর্জাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আবসার, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল ইসলাম, জন্মসনদ প্রস্তুতকারী বেলাল উদ্দিন।

ওই নারী চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে স্মার্ট কার্ড আনতে গেলে নম্বরের গড়মিল দেখে নির্বাচন কর্মকর্তারা তাকে ও তার ভাই পরিচয় দেওয়া আজিজুর রহমান নামে একজনকে আটক করে পুলিশে দেয়।

যাচাইয়ের সময় ওই নারীর ভুয়া এনআইডির তথ্য নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে দেখে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বিষ্মিত হন। এ ঘটনায় নগরীর কোতোয়ালি থানায় হাটহাজারি উপজেলার তৎকালীন নির্বাচন কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। 

সেসসময় রোহিঙ্গা নারীর তথ্য এনআইডি সার্ভারে থাকার তথ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

এরপর নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব এবং পুলিশের তদন্তে অনেক স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মচারীর পাশাপাশি কর্মকর্তাদেরও নাম বেরিয়ে আসে। অনেকেই গ্রেপ্তার হন পুলিশের হাতে, বরখাস্তও করা হয় বেশ কয়েকজনকে।

দুদকের মামলার বাদী শরীফ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রমজান বিবি নামের ওই নারীর স্বামী নজির আহম্মেদও রোহিঙ্গা। বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করে তিনি সৌদি আরবে চলে গেছেন।

নজির আহম্মেদের পরামর্শে রমজান বিবি হাটহাজারির আব্দুর সালামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তার মেয়ে পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করান।

দুদক কর্মকর্তা শরীফ জানান, সালামের মেয়ের নাম ছিল লাকী। মৃত মেয়ের পরিচয় দিয়ে তিনি রমজান বিবিকে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি ও পাসপোর্ট আবেদনে সহায়তা করেছেন।

তিনি বলেন “সালাম নিজেও রোহিঙ্গা এবং অনেক রোহিঙ্গাকে সে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেছেন বলে আমাদের তদন্তে উঠে এসেছে।

“আমরা তদন্তে পেয়েছি, হাটাহাজরি উপজেলা নির্বাচন অফিসের সার্ভার ব্যবহার করে লাকীর জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য আপলোড করা হয়েছে। কিন্তু সেটা বৈধভাবে হয়নি।”

এই দুদক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নূর আহম্মদ ফরম দুটি সরবরাহ করেছেন। জয়নাল আবেদীন নিজের বাসায় বসে ডেটা তৈরি করেন এবং হাটাহাজরির ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সাইফুদ্দিন সেগুলো আপলোড করেন।

সালাম কীভাবে বাংলাদেশে নাগরিকত্ব পেলেন এবং লাকীর স্বামী নজির আহম্মেদের পাসপোর্ট প্রাপ্তিসহ সকল বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে জানিয়ে শরীফ বলেন, যাদের এখানে সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, অভিযোগপত্রে সবাইকে আসামি করা হবে।”