পাহাড় বাঁচবে কী করে?

অবৈধ দখলকারীদের পাশাপাশি সরকারি সংস্থাও উন্নয়ন কাজের জন্য কাটছে পাহাড়। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা তাতে দীর্ঘ হচ্ছে; সঙ্গে বাড়ছে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2021, 06:16 PM
Updated : 4 June 2021, 06:16 PM

বর্ষা আসন্ন, তাই এখন আবার পাহাড়ের কতটুকু জমি দখল হয়েছে সেই তালিকা হচ্ছে নতুন করে। প্রতি বছরের মত অবৈধ স্থাপনায় গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংযোগের তালিকাও চাওয়া হয়েছে।

এসব হালনাগাদের কাজ শেষে বর্ষা এলেই শুরু হবে উচ্ছেদের তোড়জোড়। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে বসতি স্থাপনকারীদের।

এভাবেই চলছে বন্দর নগরীর ‘পাহাড় রক্ষার’ কাজ। তবে শুধু বর্ষাকেন্দ্রিক এসব তৎপরতায় চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষা ‘সম্ভব নয়’ বলেই মনে করেন পরিবেশবিদরা।

২০১৯ সালে প্রশাসনের করা তালিকার ১৭টি পাহাড়ের মধ্যে ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং বাকি সাতটি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের পাহাড় রয়েছে।

সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা ৮৩৫টি পরিবারের তালিকা হয়েছিল সে সময়। সে বছর উচ্ছেদ হয় ৩৫০টি পরিবার। বাকি থাকে আরও ৪৮৫টি।

এরপর গত বছর শুরু হয় করোনাভাইরাস মহামারী। এর মধ্যেই চলতে থাকে নগরীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটা; বাড়ে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা।

বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড নির্মাণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কাটে ১৮টি পাহাড়। এসব কাটা পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা সাড়ে তিনশর বেশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদও করা হয় গত বছর। কিন্তু সেখানে নতুন করে আরও স্থাপনা হয়েছে।  

১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা করার পর গত দুই বছরে তাতে যুক্ত হয়েছে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের আরও আটটি ছোট-বড় পাহাড়। তাই ঝুঁকিতে থাকা পাহাড়ের সংখ্যা এখন ২৫টি।

একমাসেও তালিকা মেলেনি

গত ৯ মে পাহাড় ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপনা কমিটির ২১তম সাধারণ সভা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অবৈধ সংযোগের তালিকাসহ প্রতিবেদন পাওয়ার পর ১৭ ঝঁকিপূর্ণ পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

এসব সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সাব কমিটিও করা হয়। কিন্তু অবৈধ সংযোগের তালিকা এখনো হয়নি।

যেসব সরকারি সংস্থার মালিকানাধীন পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনা আছে, তারাও এখনো তালিকা দেয়নি।   

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওয়াসা মৌখিকভাবে জানিয়েছে, পাহাড়ের অবৈধ স্থাপনায় তাদের কোনো সংযোগ নেই। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের প্রতিবেদন চেয়ে ৩১ মে তাগাদা দিয়েছি। এখনো পাইনি।  

“যেসব সরকারি সংস্থার জমিতে অবৈধ স্থাপনা আছে। তারা নতুন তালিকা এখনো দেয়নি। আমরা সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) মাধ্যমে তালিকা করছি। দুই তালিকা যাচাই করে দেখা হবে।”

আদালতে মামলা, চলছে পাহাড় কাটা

নগরীর ফিরোজ শাহ এলাকার পাহাড়ের মালিকানা রেলওয়ের। আর বাটালি হিলের নিচের মতিঝর্ণা এলাকার মালিকানা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের।  এ দুটি এলাকায় উচ্ছেদ বন্ধে আদালতে রিট মামলা চলছে।

পাহাড়ের অবৈধ বসতিতে সেবা সংস্থার সংযোগ নির্ধারণে গঠিত সাব কমিটির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক নুরুল্লাহ নূরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফিরোজ শাহ ও মতিঝর্ণার পাহাড়ে প্রায় পাঁচ হাজার করে মোট ১০ হাজার লোকের বসবাস।

“এর মধ্যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঢালে বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। কিন্তু এ দুটি এলাকার বিষয়ে আদালতে রিট আছে। তা নিষ্পত্তি না হলে উচ্ছেদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না।”

শুক্রবার মতিঝর্ণা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কয়েক মাস আগেও কাঁচা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।

আবদুল কাদের নামে একজন বললেন, ভাড়া কম বলে তারা সেখানে থাকেন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়লে পাশে নতুন ঘর করা হয়। যারা এসব ‘দেখাশোনা করে’ তাদের নতুন ঘরের জন্য টাকা দিতে হয়। কিন্তু বর্ষায় বেশি ঝুঁকি হলে প্রশাসন আবার সরিয়ে দেবে।

নগরীর কুসুমবাগে ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেখানেও শুক্রবার বিকেলে গিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা দেখা গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মনির আহমদ বললেন, “ছয় মাস আগেও পাহাড়ের নিচে থাকতাম। এখন পাশের একটা বিল্ডিংয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছি।”

প্রায় ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা ট্রাংক রোডের ফৌজদারহাট অংশ থেকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণে দুই পাশে ৯০ ডিগ্রি খাড়া করে এসব পাহাড় কাটে সিডিএ। এভাবে কাটায় এখন যে কোনো সময় পাহাড়গুলো ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

সিডিএ’র কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ৮ পাহাড়

ঢাকা ট্রাংক রোডের ফৌজদারহাট অংশ থেকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণে দুই পাশে ৯০ ডিগ্রি খাড়া করে পাহাড় কাটে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- সিডিএ।

সেসব পাহাড়ের মধ্যে আটটি ধসে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকি কমাতে আরও প্রায় দুই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটতে চেয়েছিল সিডিএ।

গত বছরের অক্টোবরে এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রস্তাব দেয় সিডিএ। এরপর অধিদপ্তর একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়।

সিডিএ এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবেদন দিলে পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেব। তারপর অনুমতি নিয়ে কাটব। এখন মোট আটটি পাহাড় ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে পাঁচটির ঝুঁকি বেশি। তবে বায়েজিদ অংশের পাহাড়গুলো স্টেবল। সেগুলো কম কাটা হবে। রিটেইনিং ওয়াল দিয়ে পাহাড় রক্ষার চেষ্টা করা হবে।”

সেই অনুমতি সিডিএকে দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক নুরুল্লাহ নুরী বলেন, “কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। ৬-৭টার মত পাহাড় ঝুঁকিতে আছে। সেখানে খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ স্থাপনাও আছে। ৯ জুন এ বিষয়ে আমাদের বৈঠক আছে। এরপর উচ্ছেদ চালানো হবে।”

এভাবে পাহাড় রক্ষা হয়?

ঝুঁকিতে থাকা বাসিন্দাদের সরাতে প্রতিবছর অভিযান হলেও তাতে যে পাহাড় ফেরানো যাবে না সেই সত্যটি মনে করিয়ে দিতে চান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, “বর্ষা এলে নামকাওয়াস্তে অভিযান হয়। আর মাঝে মাঝে কিছু মাটি কাটার লোক আর যন্ত্র ধরা পড়ে। জরিমানা হয়।

“এসবে পাহাড় ফিরে আসবে না। বায়েজিদ লিংক রোডের পাহাড়গুলো যেভাবে আছে তাতে বর্ষায় ধসে পড়বে। তারপর মাটি সরিয়ে নেওয়া হবে। পাহাড়ই আর থাকবে না।”

তিনি বলেন, “প্রভাবশালী লোকজন ও বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মালিকানাধীন পাহাড় কাটছে। পাহাড় তো শুধু মাটি না। পাহাড়ে থাকা গাছপালা কাটা হচ্ছে। ফলে জীবজন্তু, পোকামাকড়সহ সবই ধ্বংস হচ্ছে। এভাবে একসময় চট্টগ্রাম নগরী পাহাড়শূন্য হবে, সঙ্গে প্রাকৃতির ভারসাম্যও নষ্ট হবে।”

শহরে এখনো যে পাহাড়গুলো কাছে, তাতে টানা কয়েক বছর বনায়ন করা গেলে সেগুলো অন্তত রক্ষা পাবে বলে মনে করেন বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের এই শিক্ষক।

পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েস এর সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, শৈশবে শহরে যত পাহাড় তিনি দেখেছেন, তার অর্ধেকও এখন অবশিষ্ট নেই।

“বর্ষা এলে উচ্ছেদ চালিয়ে পাহাড় কাটা থামানো যাবে না। দু’মাস উচ্ছেদ হয়, আর পাহাড় কাটা চলে ১০ মাস। এভাবে আরো কয়েক বছর চললে নগরীতে আর পাহাড়ের অস্তিত্বই থাকবে না।”