‘সমাজ সেবক’ পরিচয়ের আড়ালে তিনি ডাকাত

গরু চুরির মাধ্যমে পা রাখেন অপরাধ জগতে। এই কাজে হাত পাকানোর এক পর্যায়ে হয়ে ওঠেন ডাকাত দলের নেতা। কিন্তু তার এই পরিচয়ের কথা এলাকার মানুষের অজানা; তাদের কাছে তিনি ‘সমাজ সেবক’।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 May 2021, 01:37 PM
Updated : 31 May 2021, 01:37 PM

চট্টগ্রামে আবুল খায়ের গ্রুপের পরিবেশকের গুদাম থেকে ৩৩ লাখ টাকার সিগারেট লুটের মূল হোতা নূর নবীর এমন পরিচয়ের কথা জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশের ভাষ্য, ডাকাতির জন্য দেশের সবপ্রান্তেই তার লোক আছে। পিকআপে করে গিয়ে লুট করে নিয়ে আসে মালামাল তারা। আর ডাকাতিতে বাধা পেলেই গোলাগুলি, খুন সবই করে নূর নবীর দল।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন থেকে রোববার গ্রেপ্তার করা হয় নূর নবীকে। নগরীর ডবলমুরিং থানা পুলিশের সাথে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দলও তাকে ধরতে অভিযানে অংশ নেয়।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-বন্দর) নোবেল চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বছর দশেক আগে গরু চুরি করে অপরাধ জগতে আসেন নূর নবী। পরে নিজেই দল গড়ে তোলেন, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডাকাতি করে বেড়ায়।

“আগে বিভিন্ন দোকানে ডাকাতি করলেও বছর খানেক ধরে নূর নবী ও তার দলের টার্গেট বিভিন্ন সিগারেটের দোকান ও ‍গুদাম। মালামাল রাখতে সুবিধা, সহজে বিক্রি ও বহনের জন্য সে সিগারেটের গুদাম কিংবা দোকানগুলো বেছে নেয়।”

যেসব দোকানে অন্তত ২০ লাখ টাকার সিগারেট পাওয়া যাবে সেসব দোকান কিংবা গুদাম হচ্ছে তাদের ডাকাতির লক্ষ্য।

পুলিশ জানায়, গত কয়েক মাসে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও কামাল বাজারে রফিক স্টোর নামে একটি দোকান থেকে ২৫ লাখ টাকার ৭৩ কার্টন, সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে আফজাল হোসেন নামের একজনের প্রতিষ্ঠান থেকে ২২ লাখ টাকার ৬৩ কার্টন সিগারেট ও নগদ দেড় লাখ টাকা, সর্বশেষ ডবলমুরিং থানার পোস্তার পাড়া থেকে ৩৩ লাখ টাকার ৯৪ কার্টন সিগারেট লুট করার তথ্য দিয়েছেন গ্রেপ্তার নূর নবী।

এছাড়া চাঁদপুরের কচুয়া থেকে সাইফুল স্টোর নামের প্রতিষ্ঠানের ২২ কার্টন সিগারেট, সাড়ে চার লাখ টাকা ও টেকনাফের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২২ লাখ টাকার সিগারেট লুট করেছে নূর নবীর বাহিনী।

ডবলমুরিং থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন জানান, পোস্তার পাড়ায় ডাকাতির আগে তারা পাহাড়তলী সরাইপাড়া এলাকায় আবুল খায়ের গ্রুপের আরেকজন পরিবেশকের গুদামে হানা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হয়ে তারা পোস্তার পাড়ায় আসে।

এডিসি নোবেল চাকমা বলেন, “দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করে নূর নবী ও তার দলের সদস্যরা। তাদের দলে ২০-২৫ জন সদস্য আছে। বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে স্থানীয় কিছু লোকজনকেও তার যুক্ত করে দলে।

“বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর নিয়ে সেখানে গিয়ে রেকি করে নূর নবী। তারপর নোয়াখালী, হাতিয়া ও কুমিল্লা থেকে লোক জড়ো করে পিকআপ নিয়ে সেখানে চলে যায়। স্থানীয় কিছু লোকজন নিয়ে ডাকাতি করে দ্রুত সময়ে ফিরে আসে। যে স্থানে নূর নবী ডাকাতি করবে সেখানে ব্যবহার করা মোবাইল ফোন ও সিম বন্ধ করে ফেলে তারা। আবার নতুন নম্বর থেকে যোগাযোগ শুরু করে।”

কুমিল্লার স্টেশন রোডের মুদি ব্যবসায়ী শাহজাহান ও তার ছেলে শান্ত। নূর নবীর দলের কাছ থেকে লুটের সিগারেট কিনেছিলেন তারা।

ডাকাতিতে বাঁধা পেলেই নূর নবী খুন এবং গোলাগুলি করেন জানিয়ে তিনি বলেন, পতেঙ্গায় এলাকায় গত মার্চ মাসে নৈশ প্রহরীকে খুন করে আকিজ গ্রুপের একটি গুদাম থেকে সিগারেট লুটের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন নূর নবী। একই কায়দায় কুড়িগ্রামেও খুন করে ডাকাতি করার কথা জানিয়েছেন।

পুলিশ কর্মকর্তা নোবেল চাকমা জানান, সিলেট, কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার পুলিশ নূর নবীকে খুঁজছে। তবে এক স্থানে বেশি সময় না থাকা এবং ঘনঘন মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করায় তার অবস্থান শনাক্ত করা দূরূহ হয়ে উঠে ।

“বাড়বকুণ্ড থেকে রোববার সে হাতিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তার আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।”

গাড়ি চালানোয় দক্ষ নূর নবী বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে মালামালভর্তি পিকআপ নিজেই চালিয়ে নিয়ে যান বলে জানান গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক প্রিটন সরকার ।

গত ২৭ মে ভোরে ডাকাতি করেই নূর নবী কুমিল্লায় গিয়ে মালামাল ১৯ লাখ টাকায় বিক্রি করে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।

প্রিটন জানান, ২৭ তারিখ নূর নবী চট্টগ্রামে আসার সময় তার তৃতীয় স্ত্রীকেও সাথে নিয়ে আসেন। এক পরিচিত ব্যক্তির বাসায় স্ত্রীকে রেখে নিজে থাকেন একটি আবাসিক হোটেলে।

“সেখান থেকে পরদিন বাড়বকুণ্ডে এক সহযোগীর বাড়িতে গিয়ে উঠে স্ত্রীকে নিয়ে। আর সেখান থেকে গ্রেপ্তার হয়।”

এলাকায় পরিচিতি ‘সমাজ সেবক’ হিসেবে

এডিসি নোবেল চাকমা জানান, ডাকাত নূর নবী তার নিজ এলাকার মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে ‘সমাজ সেবক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। স্থানীয় একটি ক্লাবের সভাপতিও তিনি।

“পাশাপাশি স্থানীয় চেয়ারম্যানের সাথেও তার সখ্যতার বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। যার নির্বাচনে সহায়তার জন্য নূর নবী হাতিয়া যেতে চেয়েছিল।”

নূরনবী ছাড়াও তার অন্য দুই ভাইও ডাকাত দলের সদস্য বলে দাবি করেছেন ডবলমুরিং থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন।

তিনি জানান, নূর নবীর বড় ভাইও ডাকাতির মামলায় কারাগারে আছেন।

ডাকাতির মালামাল বিক্রি কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জে

এডিসি নোবেল চাকমা জানান, ডাকাতির মালামাল তারা নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লায় নিয়ে যায়। সেখানে তাদের পরিচিত দোকানে তারা মালামালগুলো বিক্রি করে। মালামাল বিক্রির জন্য ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করেন দলের এক সদস্য।

২৭ মে চট্টগ্রাম থেকে লুট করা সিগারেটগুলো কুমিল্লায় বিক্রি করা হয়েছিল।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা নোবেল চাকমা বলেন, “নূর নবীকে গ্রেপ্তারের পর সে জানিয়েছে সকাল আটটার মধ্যেই তারা লুট করা সিগারেট নিয়ে কুমিল্লার স্টেশন রোড এলাকায় পৌঁছে যায় । সেখানে আগে থেকেই শাহজাহানের ছেলে শান্তর সাথে তারা যোগাযোগ করে রেখেছিল সিগারেট বিক্রির জন্য। শান্তর কাছে ১৯ লাখ টাকায় সিগারেটগুলো বিক্রি করে তারা চলে আসে।”

গ্রেপ্তার শাহজাহানের কুমিল্লা স্টেশন রোডে একটি মুদির দোকান আছে। তারা কম দামে সিগারেট কিনে বেশি দামে বিক্রির জন্য।

এক পরিবেশকের উদ্ধৃতি দিয়ে ডবলমুরিং থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন জানান, ৩৩ লাখ টাকার সিগারেট বিক্রি করে দোকানদার লাভ করতে পারেন ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু লুটের সিগারেট বিক্রি করে তাদের লাভ হতো ১৪ লাখ টাকা।

“জিজ্ঞাসাবাদে শান্ত জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নম্বর থেকে যোগাযোগ করে নূর নবী ও তার দলের এক সদস্য।”

ওসি মহসিন জানান, এ ডাকাতির সাথে আরও ৯ থেকে ১০ জন জড়িত থাকলেও ধরা পড়েছে মাত্র একজন। তারা কোন গাড়ি ব্যবহার করে ডাকাতি করেছে, বিক্রি করা টাকা কিভাবে বন্টন ও খরচ করেছে সেসব বিষয়ে নূর নবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

“পাশাপাশি শান্তকেও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন কতদিন ধরে তারা এসব মালামাল কিনছে, আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন।”

এদিকে নূর নবী ও শান্তকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অঅদালত তিন দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছে বলে জানিয়েছেন ডবলমুরিং থানার ওসি মহসিন।