‘প্রকৃতির বৈরিতায়’ হালদায় ডিম মিলেছে গতবারের এক চতুর্থাংশ

নদীতে মাছের আনাগোনা থাকলেও এবার ‘প্রকৃতির বৈরিতায়’ গতবারের তুলনায় এক চতুর্থাংশ ডিম মিলেছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদায়।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 May 2021, 07:41 AM
Updated : 28 May 2021, 08:25 AM

প্রাথমিক হিসেবে এবার সাড়ে ৬ হাজার কেজির মত ডিম মিলেছে, যেখানে গতবছর পাওয়া গিয়েছিল ২৫ হাজার কেজি।

প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম ডিম পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন হালদায় মাছের ডিম সংগ্রহকারীরা। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, অনুকূল পরিবেশ পেলে জুনে হয়ত আবার ডিম ছাড়তে পারে মা মাছ।

এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত সময়ে বজ্রসহ বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল নামলে উপযুক্ত তাপমাত্রা ও লবণাক্ততায় অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ার ও ভাটার সময়ে নিষিক্ত ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মাছ।

এবার হালদায় মা মাছের ডিম ছাড়া শুরু হয় বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে। ওই সময় থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ নৌকা নিয়ে দেড় হাজারের মত সংগ্রহকারী হালদায় মাছের ডিম সংগ্রহ শুরু করেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার মধ্যেই ডিম সংগ্রহ শেষ হয়ে যায়।

পূর্ণিমার তিথি শুরু হওয়ায় আগে থেকেই ডিম আহরণকারীরা নৌকা নিয়ে নদীতে অবস্থান নেন। ছবি: সুমন বাবু

হাটহাজারী উপজেলার মাদার্শা এলাকার ডিম আহরণকারী আশু বড়ুয়া শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাতটি নৌকা নিয়ে মাত্র আড়াই বালতি ডিম পেয়েছি। শুধু আমি একা না, সবার একই অবস্থা। আমরা খুব হতাশ। এবার মাছের আনাগোনা ভালো ছিল। কিন্তু ততটা ডিম ছাড়েনি।”

ডিম সংগ্রহকারী এবং হালদা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃষ্টি হয়নি বলে পাহাড়ি ঢল ছিল না। কাপ্তাই বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার পরিমাণও ছিল কম। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের সময় কর্ণফুলী নদী হয়ে অতিরিক্ত পরিমাণে লবণাক্ত পানি হালদা নদীতে ঢুকেছে।

ফলে লবণাক্ততা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৭২ গুণ বেশি ছিল জানিয়ে হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেছেন, এই সব কিছু প্রভাব পড়েছে মাছের ডিম ছাড়ার ক্ষেত্রে। 

হালদা পাড়ের দুই উপজেলার মধ্যে হাটহাজারীতে তিনটি এবং রাউজানে একটি সরকারি হ্যাচারি আছে। পাশাপাশি দুই উপজেলায় মাটির কুয়া আছে মোট ১৬৫টি। এসব হ্যাচারি ও কুয়াতে চলছে নিষিক্ত ডিম ফুটিয়ে রেণু সংগ্রহের কাজ।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলি জানান, ডিম ও রেনুর পরিমাণ নির্ধারণে গঠিত সরকারি কমিটির চূড়ান্ত হিসাব মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করা হবে।

তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রাথমিক হিসেবে এবার ৬ হাজার ৫০০ কেজির মত ডিম মিলেছে বলে অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া জানান।

রাউজান উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা পীযূষ প্রভাকর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোবারকখিল হ্যাচারিতে ৭০০ কেজির মত ডিম এসেছে। এবার ডিম সংগ্রহ কম। আজিমের ঘোনার দিকে যারা ছিলেন, তারা কিছু ডিম পেয়েছেন। নাপিতের ঘোনা থেকে ভাটির দিকে যারা ছিলেন, তারা বলতে গেলে ডিমই পাননি।”

তার হিসাবে নৌকা প্রতি সংগ্রহ গড়ে এক থেকে দেড় কেজি। সংগ্রহকারীদের অনেকে শূন্য হাতেও ফিরেছেন।

“মা মাছ ডিম ছাড়ার ঘণ্টাখানেক আগে থেকে জোয়ার শুরু হয়। এতে কিছু ডিম নদীর সাথে যুক্ত খালগুলোতে ভেসে যায়। বৃষ্টি না হওয়ায় পানির তাপমাত্রা ছিল ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। ২৫ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে আমরা অনুকূল তাপমাত্রা বলি।”

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে লবণ পানি নদীতে প্রবেশের পাশাপাশি হালদা পাড়ের কিছু মাটির কুয়াও ভাসিয়ে নিয়েছে বলে পীযূষ প্রভাকর জানান।

হাটাহাজারী উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে ১১২ বালতি, শাহ মাদারি হ্যাচারিতে ৯১ বালতি এবং মদুনাঘাট হ্যাচারিতে ৭৭ বালতি ডিম এসেছে। ডিম ফুটানো শুরু হয়েছে। রেণুর মান ভালো। রোববার থেকে রেণু বিক্রি শুরু হবে।”

প্রতি বালতি ১২ কেজি হিসেবে এই তিন হ্যাচারিতে ৩ হাজার ৩৬০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে।

রনিরও বলছেন, ইয়াসের প্রভাবে হওয়া অস্বাভাবিক জোয়ারের সময় মা মাছ ডিম ছাড়ায় তার একাংশ ভেসে গেছে।

“এবার বৃষ্টি হয়নি। পাহাড়ি ঢলও ছিল না। তারপরও জোয়ারে অতিরিক্ত পানির প্রবাহের কারণে মা মাছ ডিম ছেড়েছে বলে ধারণা করছি।”

তবে ডিম সংগ্রহকারী আশু বড়ুয়া বলছেন, “নদীতে প্রচুর নৌকা ছিল। ডিম খালে গেলেও আমরাই পেতাম। ডিম আসলে বেশি দেয়নি। আশা করছি, জুনে আরো একবার মা মাছ ডিম ছাড়বে।”

গতবছর এ মৌসুমে হালদা থেকে সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করার কথা জানিয়েছিল জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, যা ছিল ২০০৬ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০০৬ সালে ৩২ হাজার ৭২৪ কেজি ডিম পাওয়া যায়।

২০১৯ সালের ২৫ মে রাতে মা মাছ ডিম ছাড়ার পর প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম থেকে ২০০ কেজি রেণু মিলেছিল। ৮০ হাজার টাকা কেজি দরে ওই রেণুর বাজার মূল্য ছিল প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা।

এর আগে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়, যা থেকে রেণু মিলেছিল ৩৭৮ কেজি।

হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বছর হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা এবং হালদা নদী রক্ষায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডিম সংগ্রহ নিয়ে ‘অন্যরকম প্রত্যাশার’ সৃষ্টি হয়েছিল।

“গত ২১ বছরের মধ্যে হালদার পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং মাছ রক্ষায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এত সফলতার পরও পরিবেশগত দুটো প্যারামিটার সব হিসাব ওলটপালট করে দিয়েছে। তাই ডিমের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ফল আসেনি।”

তবে উজানে প্রত্যাশিত বৃষ্টি হলে হালদার মাছের দ্বিতীয়বারের মতো ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানালেন মনজুরুল কিবরিয়া।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলিও বলেন, হালদায় এবার মাছের আনাগোনা ছিল উল্লেখযোগ্য। ডিম পরিপক্ক হলে মাছের পক্ষে তা পেটে রাখা কঠিন। অনুকূল পরিবেশ পেলেই কার্প জাতীয় মাছ ডিম ছেড়ে দেয়। ডিম ছাড়তে না পারলে মাছের পেটেই তা শুঁকিয়ে যায়। তাতে মা মাছের মৃত্যুও হতে পারে। 

“এপ্রিল-অগাস্ট হল কার্প জাতীয় মাছের ব্রিডিং টাইম। তবে হালদায় মা মাছ জুনের পর ডিম ছাড়ে না। জুনে আরও দুটি জো (অমাবস্যা-পূর্ণিমা তিথি) আছে। গত বছর ২০ জুন দ্বিতীয়বার ডিম ছেড়েছিল মা মাছ। আশা করি এবারও দ্বিতীয় দফা ডিম ছাড়বে।”

পুরনো খবর