চট্টগ্রাম ওয়াসার গ্রাহকদের ভোগান্তির নাম ‘গড় বিল’

দুই বছর আগে থেকে ফ্ল্যাট বা পরিবারপ্রতি ন্যূনতম পানির হিসাব ধরে যেভাবে বিল আদায় করা হচ্ছে, তাতে ব্যবহারের চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিতে হচ্ছে বলে চট্টগ্রাম ওয়াসার অনেক গ্রাহকের অভিযোগ।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2021, 11:41 AM
Updated : 5 May 2021, 11:41 AM

চট্টগ্রামের ৮০ হাজার গ্রাহকে মধ্যে দিনে এক হাজার লিটার পানির গড় হিসেবে বিল দেন ২০ হাজারের বেশি গ্রাহক, যাদের সবারই মিটার আছে এবং সিংহভাগই আবাসিক সংযোগ। 

আবাসিক গ্রাহকরা বলছেন, পানির এই ‘গড় বিল’ আদায় শুরুর পর তাদের খরচ আগের চেয়ে তিন থেকে পাঁচগুণ বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা অনেকেই এর চেয়ে কম পানি ব্যবহার করেন। একারণে অনেক বিল বকেয়া পড়েছে বলেও তাদের দাবি।

চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা দিদারুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আবাসিক-অনাবাসিক মিলিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসায় মোট সংযোগ সংখ্যা প্রায় ৮১ হাজার। এর মধ্যে মিটারবিহীন গ্রাহক আছেন দুই হাজার, যারা দৈনিক নূন্যতম এক ইউনিট (এক হাজার লিটার) পানির ব্যবহার হিসেবে বিল পরিশোধ করেন।

“আরও প্রায় ২১ হাজার গ্রাহকের মিটার থাকলেও তারাও ন্যূনতম ব্যবহার হিসেবে বিল দেন।”

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিক সংযোগে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ১২ টাকা ৪০ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ৩০ টাকা ৩০ পয়সা করা হয়েছে। সঙ্গে মোট ব্যবহৃত পানির দামের উপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়।

চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকার এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে আমাদের বাসার বিল আসত এক থেকে দেড় হাজার টাকা। দুই বছর আগে থেকে হঠাৎ করে পাঁচ হাজার টাকা বিল আসা শুরু হয়।

“প্রতি ফ্ল্যাটের জন্য গড় বিল ধরে বিল করায় এ অবস্থা হয়েছে। আমরা কত পানি ব্যবহার করি তা দেখে বিল করলে এরকম হত না।”

কাতালগঞ্জ এলাকার একটি অনাবাসিক সংযোগের বিল থেকে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ওই সংযোগের বিপরীতে বিল আসত মাসে দুই হাজার টাকার মত। জুলাই থেকে বিল আসতে শুরু করে নয় থেকে ১০ হাজার টাকা।

নগরীর চকবাজার ও আলকরণ এলাকার একাধিক সংযোগে হঠাৎ করে কয়েকগুণ বেশি বিল আসার চিত্রও পাওয়া গেছে ওয়াসার দেওয়া বিলেই।

বেশি বিল নেওয়ার কথা স্বীকার করে চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি মো. ফজলুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগে একটা হোল্ডিংয়ের বিপরীতে ৫০০ টাকা বিল আসত। এখন প্রতি ফ্ল্যাট ধরে বিল করায় খরচ বেড়েছ।

“সেখানে ১০টি ফ্ল্যাট থাকায় হয়ত পাঁচ হাজার টাকা বিল আসছে। যারা অবজেকশন দিচ্ছে তাদের বিষয় সমাধান করা হচ্ছে।”

মিটার থাকার পরও কেন এসব গ্রাহকের কাছ থেকে গড় ব্যবহার ধরে পানির বিল নেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

রাজস্ব কর্মকর্তা দিদারুল আলম বলেন, “এটা ২০১১ সালের আইনে আছে। কেউ এর চেয়ে কম ব্যবহার করলেও তাকে এই বিলই দিতে হবে। কোনো গ্রাহক বেশি ব্যবহার করলে মিটারে যা রিডিং আসবে সে পরিমাণ বিল পরিশোধ করবে।“

সিস্টেম লস ও কিছু ক্ষেত্রে মিটার রিডারদের দুর্নীতি ঢাকতে চট্টগ্রাম ওয়াসা গ্রাহকদের উপর ন্যূনতম বিল চাপিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রামের সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারো মিটার না থাকলে সেক্ষেত্রে নূন্যতম বিল ধরা যায়। কিন্তু মিটার থাকলে গ্রাহক যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করবেন তার সমপরিমাণ বিল দিবেন।

“দুই বছর আগেও সিস্টেম লস অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি হয়েছিল। সেই কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।”

পর্যাপ্ত সংখ্যক মিটার না থাকায় সংযোগ দেওয়া অব্যাহত রাখতে ২০০১ সালের ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ওয়াসার ‘গড় বিল’ আদায় শুরু করে। তখন নির্মাণাধীন ভবনের জন্য দৈনিক দুই ইউনিট (তখন এক হাজার গ্যালনে এক ইউনিট), বাসাবাড়িতে প্রতি পরিবারের জন্য দৈনিক দশমিক ৫০ ইউনিট এবং পোশাক কারখানা, হোটেল রেস্টুরেন্ট এবং ওয়াশিং প্ল্যান্টের জন্য দৈনিক পাঁচ ইউনিট গড় ব্যবহার ধরে বিল নির্ধারণ করা হয়।

এরপর ২০১৯ সালের মে মাসে তা পরিবর্তন করে ভবনের বদলে প্রতি ফ্ল্যাট বা পরিবারের বিপরীতে দৈনিক নূন্যতম ১ ঘনমিটার (এক হাজার লিটার) পানির ব্যবহার ধরে বিল জারির সিদ্ধান্ত হয়।

এই আদেশের আওতায় এখন প্রায় ২৩ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায় করা হচ্ছে বলে রাজস্ব কর্মকর্তা জানান।

গ্রাহক ভোগান্তি বন্ধে সব সংযোগে মিটার স্থাপন ও মিটারের ভিত্তিতে বিল নির্ধারণের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে মঙ্গলবার ডিএমডি (ফাইন্যান্স) মো. শামসুল আলমের নেতৃত্বে একটি কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সভায় এক বোর্ড সদস্য প্রস্তাব করেন, গড় বিলের বিষয়টি একেবারে বাতিল করে দিতে। কিন্তু হঠাৎ করে তা করা যায় না। তাই একটি কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন দিলে তা রিভিউ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

বিল বাতিলের প্রস্তাবক সদস্য মহসীন কাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক সিদ্ধান্তে তো ২০ বছর চলতে পারে না। গড় হিসাবের কারণে অনেক গ্রাহক বিল পরিশোধ করেনি।  চট্টগ্রাম ওয়াসার ১০০ কোটি টাকার বেশি বকেয়ার বড় কারণ এটা।

“এখন মিটারের কোনো অপ্রতুলতা নেই। সব সংযোগে মিটার দেওয়া হোক। যতটুকু পানি গ্রাহক ব্যবহার করবে ততটুকু বিল দেবে।”