১৩২০ মেগাওয়াটের ‘এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট’ নামের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১৬ সালে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয় একটি পক্ষ বিরোধিতায় নামে।
ওই পক্ষটি ও পুলিশের সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধীদের সংঘর্ষে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল প্রাণ ঝরে চারজনের।
এরপর সেই বিরোধের সমঝোতা বৈঠক ঘিরে ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আবার দুই পক্ষের সংঘর্ষ নিহত হয় একজন।
সবশেষ বেতন ও কর্মঘণ্টা নিয়ে শনিবার কেন্দ্রটির শ্রমিকদের বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান পাঁচ শ্রমিক।
জমি ঘিরে অসন্তোষের শুরু
সমুদ্র তীরের গণ্ডামারার জমিতে বছরের অধিকাংশ সময় লবণের চাষ হয়। বর্ষায় চিংড়ি এবং বছরে একবার শুধু হয় ধান চাষ।
প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সাত হাজার তিনশ একর আয়তনের গণ্ডামারা ইউনিয়নের ছয়’শ একর জমিই কিনেছে এস আলম গ্রুপ, যা পুরো ইউনিয়নের ১২ ভাগের এক ভাগ।
২০১৬ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি তৈরির কাজ দেওয়া হয়েছিল এনএসএন কনসোর্টিয়াম নামের এক প্রতিষ্ঠানকে।
গণ্ডামারায় তখন ‘ভিটা মাটি রক্ষাকারী এলাকাবাসী’ নামের কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন স্থানীয় একাধিকবারের নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী।
২০১৬ সালের এপ্রিল লিয়াকত অভিযোগ করেছিলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য স্থানীয় ১০ হাজার মানুষকে ভিটে-বাড়ি ছাড়া করার পরিকল্পনা করা হয়।
অন্যদিকে এস আলম ও এনএসএন কনসোর্টিয়ামের অভিযোগ ছিল, স্থানীয় রাজনীতিক লিয়াকতকে চাঁদা না দেওয়ায় তিনি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের উসকে দেন।
২০১৬ সালের ৫ এপ্রিল লিয়াকত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, বাড়ি ও জমি হারানোর ভয়ে এবং পরিবেশ দূষণের আশঙ্কায় মানুষ প্রতিবাদ করেছে। পুলিশের পোশাক পরে এস আলমের সন্ত্রাসীরা গুলি করেছে।
শনিবারের ঘটনার পর যোগাযোগ করা হলে লিয়াকত আলী বলেন, “তখন পরিবেশ ইস্যুতে মানুষ আন্দোলন করেছিল। সেটার সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।
“যেসব দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল সেগুলো মিটে গেছে। জমির ক্ষতিপূরণসহ সব দাবি পূরণ হয়েছে। পরের বছর আমি সমঝোতা বৈঠক আয়োজন করলে একটি কুচক্রী মহল সংঘর্ষ বাধিয়ে একজনকে হত্যা করেছিল।”
শনিবারের বিক্ষোভের বিষয়ে লিয়াকত বলেন, “এটা শ্রমিক অসন্তোষ। প্রজেক্টের ভেতরের বিষয়। সেখানে আমি কখনও যাইনি। স্থানীয় চেয়ারম্যান হিসেবেও আমি এই কেন্দ্রের কোনো কিছুতে নেই। পরামর্শ চাইলে দিতে পারতাম।”
এদিন ঘটনার সময় গণ্ডামারার বাইরে থাকলেও পরে ঘটনা শুনে এলাকায় যান, দাবি লিয়াকতের।
নেপথ্যে স্থানীয় একপক্ষের ইন্ধন?
শ্রমিক অসন্তোষের কারণ জানিয়ে লিয়াকত আলী বলেন, “শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন দিতে হয়। শুনেছি দুই-তিন মাসের বেতন বাকি।
“বেতন চাইলে পুলিশের কেন গুলি করতে হবে? আর রমজানে আট ঘণ্টার বদলে সাত ঘণ্টা কাজ করতে চাইলে সেটা এমন কিছু বিষয় না। কেউ স্যাবোটাজ করছে কিনা দেখা দরকার। মাসুদ সাহেবকে (এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ) উনার সমকক্ষ অনেকে দেখতে পারে না।”
শ্রমিক এবং গণ্ডামারা বাসিন্দারা শনিবারের ঘটনায় স্থানীয়দের ইন্ধন দেখছেন।
লিয়াকত আলী বলেন, “মাল সাপ্লাই দেয় নন-চিটাগোনিয়ানরা। আর শ্রমিকদের ৯০ শতাংশই বাইরের। শ্রমিক সরবরাহেও সমস্যা আছে।”
এসব কারণে শনিবারের বিক্ষোভে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী উসকানি দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটাতে পলিটিক্যাল কোনো বিষয় নেই।”
তবে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) কবির আহমেদ বলছেন, শনিবারের ঘটনায় স্থানীয় কিছু লোকজনের সম্পৃক্ততা ছিল।
স্থানীয়রা জানান, ২০১৬ সালে চারজন নিহত হওয়ার পর ২০১৭ সালে সমঝোতা হয়েছিল। তাতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অনেকে নানাভাবে লাভবান হয়েছিল। এসব কারণেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ঘিরে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে একটি পক্ষ সক্রিয়, আর তাতে স্থানীয় বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরাও ইন্ধন দেয়।
বারেবারে কেনো এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একদম শুরুর দিকে কাজের সময়ও একটি স্বার্থান্বেষী মহল এর বিরোধিতা করে তা না হওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। শনিবারের ঘটনাও পূর্বের ঘটনার সূত্র ধরেই ঘটানো হয়েছে। এখনও সেইসব দুষ্কৃতিকারী এই কেন্দ্রের পেছনে লেগে আছে।”
শনিবার ঘটনার পর অনেক শ্রমিককে কেন্দ্র ছেড়ে চলে যেতে দেখা গেছে।
কয়েক দফা প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো এই কেন্দ্রটিতে আগামী বছরের জুনের মধ্যে উৎপাদন শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন এস আলমের কর্মকর্তারা।
কেন্দ্রটিতে এস আলম গ্রুপের ৭০ শতাংশ বিনিয়োগের পাশাপাশি চিনা প্রতিষ্ঠান সেফকোথ্রি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।