‘সন্তানদের ভরণ-পোষণের মিথ্যা আশ্বাসে’ ৩ বছর বদলি কারাভোগ বিধবার

হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির বদলে প্রায় তিন বছর ধরে কারাভোগ করছেন অন্য এক নারী। আর প্রকৃত আসামি নিজের সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেছেন উচ্চ আদালতে, যা বিচারাধীন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2021, 03:37 PM
Updated : 23 March 2021, 06:54 PM

তিন সন্তানের ভরণ-পোষণের আশ্বাস পেয়ে বিধবা ওই নারী ২০১৮ সালের জুন থেকে কারাভোগ করছেন বলে কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানার পর বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয়েছে চট্টগ্রামের আদালত।

কারাগারের রেজিস্টার তলব করে যাচাইয়ের পর চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভুঁঞা মঙ্গলবার বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য মামলার নথিপত্র উচ্চ আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী ওমর ফুয়াদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রেজিস্টার যাচাই শেষে জেলে থাকা নারী ‘প্রকৃত আসামি নয়’ বলে বিচারকের কাছে প্রতিভাত হয়। আপিল বিচারাধীন থাকায় পরবর্তী নির্দেশনার জন্য নথিপত্র উচ্চ আদালতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বিচারক।

“মিনু আক্তার জানিয়েছেন, সন্তানদের খাওয়া-দাওয়া এবং আর্থিক কিছু সহায়তা দেবে বলে মর্জিনা আক্তার নামে এক নারীর কাছ থেকে বদলি জেল খাটার প্রস্তাবে তিনি রাজি হন।”

মিনু আক্তারের আইনজীবী গোলাম মাওলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওনার তিন সন্তান আছে। অথচ আশ্বাসমতে কোনো টাকা বা সন্তানদের জন্য খাবার কিছুই মিনু আক্তার পায়নি।”

২০০৬ সালে নগরীর রহমতগঞ্জে এক নারীকে হত্যার ঘটনার বিচার শেষে ২০১৭ সালে ছালেহ আহমেদের স্ত্রী কুলসুমা আক্তারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। ২০০৭ সালে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দেড় বছর কারাগারে ছিলেন; পরে জামিনে মুক্তি পান।

কিন্তু তার পরিবর্তে ২০১৮ সালের ১২ জুন থেকে কারাগারে আছেন কুমিল্লার ময়নামতি এলাকার বাসিন্দা মিনু আক্তার। বছরপাঁচেক আগে তার স্বামী ঠেলাগাড়ি চালক বাবুল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর মিনু আক্তার সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকায় আসেন।

তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। গত তিন বছর ধরে দুই ছেলে ইয়াছিন (১০) ও গোলাপ (৭) সীতাকুণ্ডের একটি এতিমখানায় থাকে এবং মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসকে (৫) স্থানীয় এক ব্যক্তি লালন পালন করছেন।  

১৮ মার্চ কারা কর্তৃপক্ষকে মিনু আক্তার জানান তিনি কোনো মামলার আসামি নন, তার নাম কুলসুমাও নয়।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুলসুমা আক্তারের নাম-পরিচয় দিয়েই কারাগারে প্রবেশ করেন তিনি। কিছুদিন আগে তিনি বলেন, তার কোনো সাজা হয়নি, তার নামে কোনো মামলা নেই। বারবার জোর দিয়ে বলার পর আমরা রেজিস্টার খতিয়ে দেখি।

“ছবি এবং উচ্চতায় আমরা পার্থক্য পেয়েছি। তারপর বিষয়টি আদালতকে জানাই। বন্দির বিষয়ে আদালতে জানানো আমাদের দায়িত্ব।”

এরপর আদালতের নির্দেশে সোমবার মিনুকে হাজির করে তার জবানবন্দি নেওয়া হয়। আদালত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল রেজিস্টারসহ কারাগার কর্তৃপক্ষকে হাজির হতে আদেশ দিয়েছিলেন।

সে অনুসারে মঙ্গলবার ২০০৭ ও ২০১৮ সালের রেজিস্টার নিয়ে আদালতে আসেন ডেপুটি জেলার। এরপর বিচারক খাস কামরায় মিনু আক্তারের সাথে কথা বলেন এবং নথি যাচাই করেন । 

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালের ৯ জুলাই নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় মোবাইল নিয়ে বিবাদের জেরে পোশাক কারখানার কর্মী কোহিনুর বেগম খুন হন। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর খুনের দায়ে কুলসুমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়।

মিনুর ভাই রুবেল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুলসুমার পরিবর্তে মিনু আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তার সন্তানদের খাওয়া-পড়া আর কিছু টাকা দিবে এবং তিন মাসের মধ্যে জামিন করাবে বলে প্রস্তাব দেন মর্জিনা আক্তার। ওই প্রস্তাবে রাজি হয়ে ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

“কিন্তু আমার বোন কারাগারে যাওয়ার পর মর্জিনা আর কোনো টাকা-পয়সা দেয়নি, যোগাযোগও করেনি। এরপর তিন বছর কেটে গেছে, জামিনও করায়নি।”