ওদের লড়াইটা নিজেদের জন্যও

“বাড়িতে বলেছি, আপুদের কম বয়সে বিয়ে দিলেও আমাকে দিতে পারবেন না। তখন বাবা-মা বলেছেন, তোর যতটুকু স্বপ্ন ততটুকু তুই পড়তে পারবি।”

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2021, 03:00 PM
Updated : 8 March 2021, 03:01 PM

কথাগুলো চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের কাজী আফাজ উদ্দিন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী কাজী ফাতেহার। 

বাল্যবিয়ে নিয়ে নিজের পরিবারেই দেখেছেন ফাতেহা। আর তা তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তিন বোন। দুই বোনেরই কম বয়সে বিয়ে হয়েছে। একটা সময় জানতাম না, বাল্যবিয়েতে কী ক্ষতি হয়। যখন অষ্টম শ্রেণিতে তখন জানতে পারি বাল্যবিয়ে হলে একটা মেয়ের আর নিজের পায়ে দাঁড়ানো হয় না। কীভাবে সাফার করে জীবনে।”

লেখাপড়া শেষ করে স্বাবলম্বী হতে চান কাজী ফাতেহা। তাই নিজের পরিবারকে রাজি করিয়েছেন। আর স্কুলের কোনো সহপাঠীর বাল্য বিয়ের খবর পেলেও তা বন্ধ করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন বন্ধুদের নিয়ে।

তার সহপাঠী কাজী সাদিয়া এহসান বলেন, “আমাদের পাড়ায় কেউ বাল্যবিয়ে দিতে চাইলেও আমাদের ভয়ে দিতে পারে না। সবাই জানে আমরা হেল্প সেন্টার, খবর পেলে প্রশাসনকে জানিয়ে দিব।”

সচেতনতা বাড়ায় সন্দ্বীপে বাল্যবিয়ে কমেছে বলে দাবি করেন সাদিয়া। তবে তিনি বলেন, লেখাপড়া শেষে দ্বীপে যদি মেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকত তাহলে বাল্যবিয়ে পুরোপুরি বন্ধ হত।

প্রবাসী অধ্যুষিত সন্দ্বীপের বাসিন্দা প্রায় চার লাখ। মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ২৯টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার, যার মধ্যে অর্ধেকই ছাত্রী।

দরিদ্রতা ও সচেতনতার অভাব আর প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা-এই তিন কারণে সন্দ্বীপে বাল্যবিয়ের প্রবণতা একটু বেশি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) ২০১৮ সালের জুন থেকে জার্মানভিত্তিক দাতা সংস্থা ব্রেড ফর দ্য ওয়ার্ল্ডের সহায়তায় সন্দ্বীপের ১০টি স্কুলে ‘প্রমোটিং রাইটস থ্রু মোবিলাইজেশন অ্যান্ড এম্পাওয়ারমেন্ট (প্রাইম)’ নামের প্রকল্প শুরু করে।

এর আওতায় ১০টি স্কুলের শিক্ষার্থী ও সাবেক শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১০ সদস্যের ‘চেঞ্জমেকার’ দল গঠন করে, যারা বাল্য বিয়ে-ইভটিজিং বন্ধসহ ছাত্রীদের প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে কাজ করে।

আরেক ছাত্রী হীরা বেগম বলেন, “সচেতন হওয়ায় এখন ছাত্রীরা বিয়ে ঠিক হলে প্রতিবাদ করে। কাজ না হলে, আমাদের জানায়। তখন আমরা শিক্ষকদের জানালে উনারা ব্যবস্থা নেন।

“আগে স্কুলের বাইরে ইভটিজিং হত। প্রতিবাদ করায় এখন বন্ধ। আমাকে একবার টিজ করায় বড় ভাইদের জানাই। তারা সাবধান করার পর ওই ছেলেকে আর এলাকায় দেখিনি। ট্রিপল নাইনে ফোন করে একবার এলাকার মারামারিও থামিয়েছি।”

এই স্কুলের সাবেক ছাত্র সন্দ্বীপ এবি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নিজাম উদ্দিন বলেন, “আগে মেয়েদের তো বাল্যবিয়ে দিতই, আবার সবাইকে এমন বিয়ের দাওয়াতও দিত। এখন সবাই জানে খবর পেলে আমরা পুলিশ বা প্রশাসনকে জানিয়ে দিব। তাই বাল্যবিয়ে কমে গেছে। দুয়েকটা হলেও খুব গোপনে।” 

২০১৯ সালে উপজেলার দ্বীপবন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে ঠিক হয়। তার সহপাঠী চেঞ্জমেকার দলের সদস্য নাজমুল আলমকে তিনি বিষয়টি জানান।

নাজমুল আলম বলেন, “মেয়েটি শিখিয়ে দেওয়া মতে বাড়িতে গিয়ে বলে, বাল্যবিয়ে দিলে পুলিশ এসে বন্ধ করবে। তখন পরিবার ভয়ে আর বিয়ে দেয়নি। এখন সে দ্বীপবন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছে।”

আরেক চেঞ্জমেকার শিমুল রায় জানান, ২০২০ সালের ২ এপ্রিল সন্দ্বীপের এক মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। ওই বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির এক সদস্যের ছেলে মারুফ হোসেন ও তার এক সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ছাত্রীটির বাবা। মারুফ হোসেন পালিয়ে যান।

তখন সন্দ্বীপ জুড়ে আন্দোলনে নামে ছাত্রছাত্রীরা। দ্বীপ থেকে পালিয়ে যাওয়া মারুফ হোসেনকে ১৬ দিন পর সীতাকুণ্ড বাজার থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

আখতারা-খালেদাও লড়ছেন

উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মালাধর পাড়ায় এক জরাজীর্ণ কাঁচা ঘরের বাসিন্দা আখতারা বেগম। এ পাড়ার বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ।

আখতারার স্বামী দিনমজুরের কাজ করেন। এ দম্পতির দুই ছেলে দুই মেয়ে। ছোট ছেলের (১৫) স্কুলে পড়ার কথা থাকলেও অভাবের কারণে বাজারে দোকানে কাজ করে।

আখতারা বেগম জানান, দুই মেয়েরই কম বয়সে বিয়ে দিয়েছেন। সংসারে অভাব তাই বিয়ে না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না।

বাল্যবিয়ের শিকার সন্দ্বীপের খালেদা বেগম এখন সেলাইয়ের কাজ শিখে স্বাবলম্বী।

বাল্য বিয়ে হয়েছিল মুছাপুরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ধনগাজির বাড়ির খালেদা বেগমেরও। সেই সংসার টিকেছিল চার বছর। তারপর ছেলে নিয়ে বাবার বাড়িতে ঠাঁই হয়েছে তার।

খালেদা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগে হাঁস-মুরগি পালতাম। তারপর আমার মা আমাকে সেলাইয়ের কাজ শেখাতে নিয়ে যায়।

“বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা থেকে সেলাই মেশিন কেনার টাকা দিয়েছে। এখন দিনে আয় দুই-আড়াইশ টাকা। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চাই। আমার মেয়ে থাকলে কখনও বয়স হওয়ার আগে বিয়ে দিতাম না।”

খালেদা বলেন, “কম বয়সে বিয়ে হওয়ায় সংসারের অনেক কিছু বুঝিনি। বোঝাপড়া হয়নি, অর্থনৈতিক সমস্যাও ছিল।”

সন্দ্বীপের আখতারা বেগম এখন প্রতিবেশীদের বোঝাচ্ছেন বাল্যবিয়ের কুফল।

আখতারা বেগমের জন্য সরকারি বিভিন্ন সহায়তা অথবা খালেদা বেগমের জন্য প্রশিক্ষণসহ নানা সরকারি সুবিধা আদায়ে সহযোগিতা করেন বলে জানান বিএনপিএসর সন্দ্বীপ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. শামসুদ্দীন।

সন্দ্বীপের রহমতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাস্টার ইলিয়াস খান (অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক) বলেন, সচেতনতার অভাবে নিম্ন আয়ের পরিবার এবং লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি ছিল।

“এখন অনেকটাই কমেছে। প্রবাসী পাত্র পেলে তবু কেউ কেউ গোপনে মেয়ের বিয়ে দিতে চায়। কারণ সেক্ষেত্রে পাত্রীর পরিবারকে যৌতুক দিতে হয় না এবং বিয়ের খরচ কম করলেও চলে।”

মাস্টার ইলিয়াস খান বলেন, “জন্ম নিবন্ধন ডিজিটাল হওয়াতে এখন আর ১৩ বছরকে ১৮ বছর বানানো যায় না। আমরাও সুযোগ দিই না।”

সাউথ সন্দ্বীপ আবেদা ফয়েজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জয়নাব বেগম বলেন, ছাত্রীরা এখন নিজেরাই বলে- বাল্য বিয়ে করব না, পড়ব। ওরা শিখছে, প্রতিবেশীকে শেখাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে।

সাগরবক্ষের সন্দ্বীপ সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিডে যুক্ত হয়েছে ২০১৮ সালের নভেম্বরে। সেই থেকে দ্বীপে আলোর রোশনাই।

জীবনে জয়ী হতে লড়ে যাচ্ছে ফাতেহা, হীরা, আখতারা আর খালেদা বেগমরা। সেই লড়াইয়ে জিতে সব প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে একদিন ওরাই দ্বীপকে আলোকিত করবে এমনটাই বিশ্বাস শিক্ষিকা জয়নাব বেগমের।