চট্টগ্রামে পাহাড়তলি বধ্যভূমির পুরো জমি অধিগ্রহণের দাবি

চট্টগ্রামের পাহাড়তলি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য আদালত নির্দেশিত এক দশমিক ৭৫ একর জমির পুরোটাই ২৬ মার্চের মধ্যে অধিগ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে এক কর্মসূচি থেকে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2021, 02:30 PM
Updated : 6 Feb 2021, 02:30 PM

শনিবার বিকেলে নগরীর পাহাড়তলি বধ্যভূমির সামনের সড়কের মানববন্ধন ও উন্মুক্ত সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ‘পাহাড়তলি বধ্যভূমি রক্ষা পরিষদের’  আয়োজনে।

অবিলম্বে বধ্যভূমিটির পুরো জমি অধিগ্রহণ করা না হলে লাগাতার কর্মসূচি পালনের ঘোষণাও দেওয়া হয়।

কর্মসূচিতে বধ্যভূমি রক্ষায় রিটকারীদের অন্যতম প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, “চট্টগ্রামে মোট ১১১টি বধ্যভূমি থাকলেও একটি বধ্যভূমিও রক্ষা করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এই পাহাড়তলি বধ্যভূমি শুধু টিকে আছে আমাদের মামলার কারণে। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী রায়েরবাজার ও পাহাড়তলি বধ্যভূমি রক্ষার নির্দেশ দিলেও এখনো তা হয়নি।

“এই বধ্যভূমি রক্ষার জন্য লড়াই করায় আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়, জমির প্রস্তাবও দেয়া হয়। আমরা কোনো স্মৃতিই সংরক্ষণ করতে পারিনি বলে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না।”

ওই জমিটি ইউনির্ভাসিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) মালিকানায় রয়েছে।

১৯৯৯ সালে ওই বধ্যভূমির স্মৃতি রক্ষার্থে তৎকালীন সরকার জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়। এই প্রকল্পের জন্য ৯৮ লাখ টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকার প্রকল্পটি বাতিল করে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অধ্যাপক জাফর ইকবাল, মুনতাসির মামুন ও গাজী সালেহ উদ্দিনসহ কয়েকজন হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।

পাহাড়তলি এলাকায় বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত জমিতে ২০০৭ সালে একটি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ। এর বিরুদ্ধে ২০১০ সালে আরেকটি রিট আবেদনে ওই ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেয় আদালত।

২০১১ সালের ৬ জুন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, তদন্ত শেষে পাহাড়তলি বধ্যভূমির স্থান নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। 

ওই কমিটির কাছে সাক্ষ্যদাতাদের বক্তব্য অনুসারে, প্রায় পৌনে ২ একর এলাকা জুড়ে বধ্যভূমি ছিল। পুরো এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মানুষের মাথার খুলি, কঙ্কাল ও হাড়গোড়।

১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর পাহাড়তলিতে গণহত্যা সংঘটিত হয়।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ স্থানে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করা হয় বিহারিদের সহায়তায়।

গাজী সালেহ ‍উদ্দীন বলেন, “এ বধ্যভূমি নিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে গেলে বারবার মামলার অজুহাত দেয়া হত। পরে উচ্চ আদালতের আদেশও এনেছি। কিন্তু প্রকল্প আর আগায় না। এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য প্রায় পৌনে সাত কোটি টাকা প্রাক্কলন ধরা হয়েছে বলে শুনেছি।”

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৪ সালের ১১ মার্চে দেয়া এক আদেশে এক দশমিক ৭৫ একর জমির সম্পূর্ণ অংশ পাহাড়তলি বধ্যভূমি বলে রায় দেয়া হয়।

ড. গাজী সালেহ উদ্দীন বলেন, “চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে জমি অধিগ্রহণের জন্য অর্থের চাহিদাপত্র ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২০১৮ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৯ শতক পরিমাণ জমির মধ্যে সরকার দেশের সব চিহ্নিত বধ্যভূমি সংরক্ষণ করবে।

“এরপর এই সিদ্ধান্তকে ভিত্তি করে একটি চক্র বধ্যভূমিটি রক্ষায় আদালতের সিদ্ধান্তকে আংশিক বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়েছে। আমাদের ২০১৪ সালের রায় আছে, ২০১৮ সালের সিদ্ধান্ত এখানো খাটবে না। দুই সপ্তাহ আগেও মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি, বলেছি এটা আদালতের রায় অনুসারে না হলে আমরা মামলা করব।”

অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দীন বলেন, “চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিয়েছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, প্রয়োজনে মন্ত্রী থেকে বিশেষ বরাদ্দ নেবেন। আমাদের দাবি পুরো জমি অধিগ্রহণ করুন। ২৬ মার্চের আগেই অধিগ্রহণ করতে হবে। এখানে হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। তা না হলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাব।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন প্রফেসর এবিএম আবু নোমান বলেন, “দেশের সবচেয়ে বড় এই বধ্যভূমিকে রক্ষায় সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং আপিলে এক দশমিক ৭৫ একর জমি রক্ষার কথা বলা আছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করি তারা আজ দাঁড়িয়েছি। ভবিষ্যত প্রজন্ম দেখবে কিভাবে এখানে আমাদের শহীদরা রক্ত দিয়েছেন।

“আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে এই বধ্যভূমি তারই স্মারক। অথচ ধীরে ধীরে এখানে অবকাঠামো নির্মাণ হয়ে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ আমাদের এই দায় থেকে মুক্ত করুন। বধ্যভূমিটি রক্ষা করুন।”

দাবিনামা পাঠ করে শরীফ চৌহান বলেন, আমাদের চারটি দাবি। এগুলো হলো- এখানে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ২৬ মার্চের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ, অনতিবিলম্বে বধ্যভূমির জন্য প্রাক্কলিত অর্থ ছাড় করা এবং লাইট এন্ড সাউন্ড শোর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। দল মত নির্বিশেষে সবাই এ আন্দোলনে সামিল হয়েছি, অবশ্যই আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারব।

সাংস্কৃতিক সংগঠক ও প্রমা সভাপতি রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় মানববন্ধন চলাকালে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন অধ্যাপক হোসাইন কবির, সাংস্কৃতিক সংগঠক সুনীল ধর, শহীদ পরিবারের সদস্য মো শাহাবুদ্দিন আঙ্গুর, রাউফুল হোসেন সুজা ও আনোয়ার হায়দার, ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির চট্টগ্রাম জেলার কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক অনিক চৌধুরী, বিজয় একাত্তর সভাপতি আর কে রুবেল।

উপস্থিত ছিলেন নাট্যকার আহমদ কবীর, নাট্যজন মোস্তফা কামাল যাত্রা, অধ্যক্ষ সুকুমার দত্ত, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কাজল বরণ চৌধুরী প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনের আগে প্রদীপ দেওয়ানজি রচিত গীতি নকশা ‘বধ্যভূমি’ পরিবেশন করে নাট্যাধার। সংহতি জানিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নেয় শোভন থিয়েটারসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।