ভোট দিচ্ছে চট্টগ্রাম

মহামারীর বাধা আর সংঘাত-সহিংসতা পেরিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে ভোট দিচ্ছেন বন্দরনগরীর বাসিন্দারা।

মিন্টু চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2021, 02:10 AM
Updated : 27 Jan 2021, 03:50 AM

নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নগরীর ৭৩৫টি কেন্দ্রে বুধবার সকাল ৮টায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে, একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে।

শীতের সকালের শুরুতেও বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে ভোটারদের উপস্থিতি দেখা গেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিতি আরও বাড়বে বলে কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।

সকালে ভোটগ্রহণের শুরুতেই নগরীর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কদম মোবারক এমওয়াই উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। একই ওয়ার্ডে মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি (এমইএস) উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

এমইএস উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার সুরজিৎ বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার কেন্দ্রে মোট ১৬২০ ভোট। প্রথম আধ ঘণ্টায় ১২টি ভোট পড়েছে। ভোট গ্রহণ ‘সুষ্ঠুভাবেই’ চলছে।

১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন ভোটার এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র, ৩৯ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ১৪ জন নারী কাউন্সিলরকে নির্বাচিত করবেন।

নির্বাচনে মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের মধ্যে।

তবে নতুন মেয়র কে হচ্ছেন, সেই প্রশ্ন ছাপিয়ে ভোটের আগে আলোচনা ছিল ভোটগ্রহণ কেমন হয় তা নিয়ে।

করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে এমনিতেই এক ধরনের উদ্বেগ আছে। তার মধ্যে বিএনপি আগে থেকেই কারচুপির সন্দেহ প্রকাশ করে আসছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আশঙ্কা, ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বিএনপি।

তবে এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪ হাজার সদস্যও রয়েছে প্রস্তুত। ‘সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ ভোট হবে বলেই তিনি আশা করছেন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ষষ্ঠ নির্বাচন গত বছরের ২৯ মার্চ হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকায় আট দিন আগে তা স্থগিত করা হয়। এরপর পরিস্থিতির উন্নতি বিবেচনায় ২৭ জানুয়ারি ভোটের দিন ঠিক করে নির্বাচন কমিশন।

অবশ্য ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ আছে এখনও। উনিশ লাখ ভোটারের সঙ্গে ভোটগ্রহণ কর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মিলিয়ে ভোটের মধ্যে থাকবেন এক নগরীর সাড়ে ১৯ লাখের বেশি মানুষ। সেই হিসাবে প্রতি কেন্দ্রে গড়ে প্রায় ২৬০০ মানুষের উপস্থিতি ঘটতে পারে আট ঘণ্টায়।

এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মানা না হলে তা কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টরা। তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, সব স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ভোটের আয়োজন হচ্ছে, সুরক্ষার সব ব্যবস্থাই কেন্দ্রে রাখা হবে।    

ভোটের প্রচারের মধ্যে গত ১৬ দিনে মিছিল, সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন উপায়ে নগরীতে জনসমাগম হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না। গা ঘেঁষাঘেষি করে হয়েছে মিছিল। আর মাস্ক ছাড়া ভোটের প্রচার ছিল নিত্য দিনের ঘটনা।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা কামরুল আলম বলেন, “ঝুঁকি কমাতে সব ব্যবস্থাই আমরা নিয়েছি। ভোট গ্রহণের সময় কর্মকর্তারা সবাই মাস্ক পরবেন। সব কেন্দ্রে স্যানিটাইজারসহ সব সুরক্ষা উপকরণ রাখা হয়েছে। কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইভিএমে ভোট নিতে হবে, তা ট্রেনিংয়ে বলে দেওয়া হয়েছে সবাইকে।”

ভোট তথ্য

>> ভোটার সংখ্যা ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩। নারী ভোটার ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন।

>> ভোট কেন্দ্র ৭৩৫টি। ভোটগ্রহণ কক্ষ ৪ হাজার ৮৮৮৬টি।

>> ভোট গ্রহণে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ৭৩৫ জন, সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ১৪৭০ জন, পোলিং ও কর্মকর্তা ২৯৪০ জন।

>> নিরাপত্তার দায়িত্বে মোট ১৮ হাজার পুলিশ ও আনসার সদস্য। এছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে র‌্যাবের সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। মোতায়েন থাকবে ২৫ প্লাটুন বিজিবি। 

>> নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন ২০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং ৬৯ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। প্রতিটি ওয়ার্ডে থাকবেন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

>> মেয়র প্রার্থী সাতজন। অন্য প্রার্থীরা হলেন- এনপিপি’র আবুল মনজুর (আম), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন (মোমবাতি), স্বতন্ত্র প্রার্থী খোকন চৌধুরী (হাতি), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ (চেয়ার) এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জান্নাতুল ইসলাম (হাতপাখা)।

>> ৪১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন হওরয়া কথা থাকলেও আলকরণ ওয়ার্ডের প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিম মারা যাওয়ায় সেখানে কাউন্সিলর নির্বাচন হবে না। তবে মেয়র পদে ভোটগ্রহণ হবে সে ওয়ার্ডে।

>> ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত হারুন অর রশিদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।    

থাকছে অন্য শঙ্কাও

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ভোটের আগের দিন বলেছেন, বিএনপি ‘গণ্ডগোল পাকিয়ে ভোটের পরিবেশ নষ্ট করতে পারে’ বলে তার শঙ্কা রয়েছে।

নগরবাসীকে বুধবার সকালে কেন্দ্রে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো অবাঞ্ছিত কেউ যাতে কোনো গণ্ডগোল পাকাতে না পারে, সেদিকে নেতাকর্মীদের সচেতন থাকতে হবে।”

অন্যদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, সেই সন্দেহের কথা বলেছেন ভোটের আগের দিন।

“আমরা শঙ্কায় আছি। নিয়মিতই দলের কর্মী, এজেন্টদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। ভোট নিয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে।”

গত সিটি নির্বাচনে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ভোট কেন্দ্র দখল এবং জাতীয় নির্বাচনে নানা ঘটনা প্রবাহে এমনিতেই এবারের ভোট ঘিরে শঙ্কা ছিল নাগরিকদের মধ্যে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলরদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে বিদ্রোহীদের বিরোধের জেরে সংঘাত-সংঘর্ষ।

নির্বাচনী সহিংসতায় ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে দুজন নিহত হয়েছেন। ১৩ জানুয়ারি রাতে ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর এবং একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল কাদেরের সমর্থকদের সংঘর্ষে নিহত হন একজন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন আরও কয়েকজন।

এছাড়া গত বছরের মার্চ মাসে নির্বাচন স্থগিত হওয়ার আগে পাহাড়তলী সরাইপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও গতবারের কাউন্সিলর মোর্শেদ আক্তারের সমর্থক মো. তানভীর নিহত হন।

সচেতন নাগরিক কমিটির চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি আকতার কবির চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোট নিয়ে যে আতঙ্ক আছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো শুভ উদ্যোগ না থাকায় আতঙ্ক আরও বেড়েছে। মানুষ যতক্ষণ মনে করবে না সে নিরাপদ, ততক্ষণ কেন ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবে?

“পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, হামলা এসবে পরিস্থিতি আরও নেতিবাচক হয়েছে। আশা করব, ভোটাধিকার নাগরিকরা প্রয়োগ করতে পারবে। তবে সন্দিহান নাগরিকরা ভোট দিতে যাবে কি না সেটা নিয়ে।”

তিনি বলেন, “ভোটের আগের রাত সম্পর্কে খুব খারাপ অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। সেটা বলতে পারব পরে। তবে আশা করব ‍সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ভোট হবে।”

রাত পোহালেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন; মঙ্গলবার এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠানোর অপেক্ষায় ইভিএমসহ নির্বাচনী সরঞ্জাম।

তবে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান ভোটারদের নির্ভয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি ভোটের আগের দিন বলেন, “নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশও তৈরি হয়েছে।”

নগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জানিয়েছেন, ৭৩৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪১৭টি কেন্দ্রকে তারা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ শতকরা হিসেবে ৫৭ শতাংশ কেন্দ্রে রয়েছে তাদের বাড়তি নজর।

প্রতিটি কেন্দ্রে পুলিশের পাশাপাশি আনসার সদস্যরাও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। প্রতি ওয়ার্ডে দুটি করে মোবাইল টিম, প্রতিটি থানায় স্ট্রাইকিং ফোর্স রাখা হয়েছে।

পাশাপাশি জোনাল উপ-কমিশনারদের অধীনে সাব কন্ট্রোলের মাধ্যমে এবং দামপাড়া ও মনসুরাবাদ পুলিশ লাইনে স্ট্রাইকিং ফোর্স রাখা হয়েছে। র‌্যাব ও বিজিবির ২৫ প্লাটুন সদস্যও টহলে থাকছেন বলে সিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন ।

চসিকের ষষ্ঠ ভোট

ব্রিটিশ আমলে গঠিত চট্টগ্রাম পৌর করপোরেশন সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন জাতীয় পার্টির নেতা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৯১-১৯৯৩ মেয়াদে বিএনপি নেতা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন এই পদে ছিলেন।

১৯৯৪ সালে প্রথম সিটি ভোটে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। টানা তিন বার তিনি ভোটে লড়ে জয়ী হয়ে মেয়রের চেয়ারে বসেন।

মহিউদ্দিন ২০১০ সালেও ভোটের লড়াইয়ে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলমের কাছে প্রায় এক লাখ ভোটে পরাজিত হন।

মনজুর এক মেয়াদে দায়িত্ব পালনের পর আবার প্রার্থী হয়ে হারেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের কাছে।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ভোট শুরুর তিন ঘণ্টার মধ্যে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী মনজুর।

আ জ ম নাছির এক মেয়াদে দায়িত্ব পালনের পর এবার আর দলের মনোনয়ন পাননি।