যাত্রামোহনের বাড়িতে হানিফ, সংরক্ষণের আশ্বাস

চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়িটি ‘অতীত ঐতিহ্য ধারণ করে যাতে থাকতে পারে’ সে বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2021, 03:04 PM
Updated : 21 Jan 2021, 03:04 PM

বৃহস্পতিবার বিকালে যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়িটি দেখতে গিয়ে তিনি এ আশ্বাস দেন।

এর আগে ওই বাড়িটির সামনে তাৎক্ষণিক অবস্থান সমাবেশ হয় রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন।

বাড়িটির মূল ফটকে ‘দখলদারদের’ দেওয়া তালা থাকায় সেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালনকারী এবং হানিফ এবং আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়াসহ উপস্থিত কেউ বাড়ির প্রাঙ্গণে ঢুকতে পারেননি।

বাড়ির সামনের সড়কেই হওয়া অবস্থান কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তর বক্তব্য চলাকালে সেখানে উপস্থিত হন হানিফ।

এসময় রানা দাশগুপ্ত বাড়িটির সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি, বাড়িটি কিভাবে অর্পিত সম্পত্তি হয় এবং বাড়ির দখলকারীদের করা মামলার বিস্তারিত বিবরণ দেন।

এরপর সেখানে দেওয়া বক্তব্যে হানিফ বলেন, “আমি শুধু একটি বিষয়ে আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, সেটা হলো যে এটি একটি ঐতিহাসিক ভবন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি জড়িত আছে, ভবনটি ইতিহাসের অংশ। ভবনটি কেন হঠাৎ করে এরকম হলো আমার জানা নেই।

“দেখলাম এখানে কতগুলো নোটিশ টাঙ্গানো আছে আদালতের। এটুকু আশ্বস্ত করে যাচ্ছি বিষয়টা আজকে পুরোপুরি জানলাম। আজকেই জেলা প্রশাসককে বলব ঘটনাটি যথাযথভাবে দেখতে। কেন কী কারণে ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং আইনসম্মত মীমাংসা সেটি দ্রুত যেন হয়।”

হানিফ বলেন, “আশা করি, দ্রুত ঘটনাটি নিষ্পত্তি হবে। ভবনটি অতীত ঐতিহ্য ধারণ করে যাতে থাকতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের সবরকম সহায়তা থাকবে।”

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সমাবেশে বলেন, “ভূমিদস্যুরা অপকৌশলে আদালতের একটি রায় এনেছে। জেলা প্রশাসন যেখানে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে এই সম্পত্তির কাস্টডিয়ান তাদেরকে সেখানে পক্ষভুক্ত করা হয়নি। শিশুবাগকেও মামলায় প্রতিপক্ষ করা হয়নি। জেলা প্রশাসনের সম্পূর্ণ অগোচরে কিভাবে তারা এই মামলায় রায় পেল?”

৪ জানুয়ারি ভবনটি দখলচেষ্টার ঘটনা তুলে ধরে রানা দাশগুপ্ত বলেন, “সেদিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা সব পক্ষের সামনে বলেছে, আপনারা চলে যান আমরা তালা দিয়ে দিব। তখন আমি বলেছিলাম, এর দায়িত্ব স্থানীয় কাউন্সিলর (সাবেক) শৈবাল দাশ সুমনকে দিতে। প্রশাসন সম্মত হয়েছিল।

“কিন্তু দুঃখের বিষয় কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের হাতে চাবি আসেনি। দুষ্কৃতকারীরা এখানে এখনও থাকে। বাইরে থেকে তাদের জন্য খাবার আসে। পুলিশ তাদের বাধা দেয় না। ভিতরে তারা আলো আর সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছে। সেগুলো কীভাবে হচ্ছে?”

অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি তাপস হোড়, ওয়ার্কার্স পার্টির চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাশেদ হাসান।

উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট ইন্দু নন্দন দত্ত ও অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র লালা, চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্রের সভাপতি আলিউর রহমান, জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী শৈবাল দাশ সুমন, আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী জহর লাল হাজারী।

ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত রহমতগঞ্জে ১৯ গণ্ডা জমির উপর এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত।

ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহনও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়রও হয়েছিলেন। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় এই বাড়িতে এসেছিলেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও এই বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। এতে ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়ে ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যু হয়েছিল যতীন্দ্রমোহনের।

ওই জমিটি পরে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষিত হয়। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি জমিটি ইজারা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

তবে যাত্রামোহনের এক স্বজনের কাছ থেকে কেনার দাবি করে আদালতের একটি আদেশ নিয়ে ৪ জানুয়ারি বাড়িটি ভাঙতে যায় একটি পক্ষ, স্থানীয়দের নিয়ে যা ঠেকিয়ে দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।

পরে একটি রিট আবেদনে বাড়িটি ভাঙায় একমাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে উচ্চ আদালত।

চট্টগ্রামের আদালতে এই বাড়ি রক্ষায় আবেদন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সেই আবেদনের পর বাড়ি ভাঙায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে চট্টগ্রামের আদালতও।

ঐতিহাসিক বাড়িটি রক্ষায় চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়মিত কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। সবশেষ চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক সমাজ বাড়িটি রক্ষার দাবিতে ১৭ জানুয়ারি মশাল মিছিল করে।