যাত্রামোহনের বাড়ি জাদুঘর ঘোষণার দাবিতে সমাবেশ

অবিলম্বে যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ি জাদুঘর ঘোষণার দাবিতে সমাবেশ ও মশাল মিছিল করেছে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকবৃন্দ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2021, 03:39 PM
Updated : 17 Jan 2021, 03:39 PM

রোববার বিকেলে নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড় থেকে মশাল মিছিলটি যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়িতে গিয়ে শেষ হয়।

এর আগে চেরাগী পাহাড় মোড়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ থেকে বাড়িটি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ এবং ওই বাড়িতে এখনো অবস্থানকারীদের উচ্ছেদের দাবি জানানো হয়।

সমাবেশ ও মশাল মিছিলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সমাবেশ থেকে অবিলম্বে বাড়িটি জাদুঘর ঘোষণা করা না হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করা হয়।

সমাবেশের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, “আমাদের দাবির যৌক্তিকতা সরকার ইতিমধ্যে মেনে নিয়েছে বলে শুনেছি। যতদূর জেনেছি, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিপ্লবীদের স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণ করবে। আমরা যে আন্দোলন শুরু করেছি তার ধারাবাহিকতায় আজকের এ কর্মসূচি।

“অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত নাগরিকদের পক্ষে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছেন। যদি সেই সময়সীমার মধ্যে সকল দাবি মেনে নেয়া না হয় তাহলে কঠোর কর্মসূচি দিব। যাত্রামোহন সেনের বাড়ি রক্ষার দাবিতে চট্টগ্রামের নবীন-প্রবীণ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ।”

মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, “বারবার বলার পরও দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো রক্ষিত হচ্ছে না। সবশেষ চট্টগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটিও দখল করার পায়তারা চলছে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে রক্ষা করে এগিয়ে নিতে হবে। এই বাড়ি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, “স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে যখন দেশ মানবিক বাংলাদেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের ঐতিহ্যের উপর হামলা হয়েছে। যাত্রামোহন সেনের বাড়ির সাথে এই অঞ্চলের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস জড়িত। যারা বাড়িটি ভাঙার মত কাজ করেছে তারা ন্যাক্কারজনক হামলা করেছে। এই ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় আমরা সবসময় সোচ্চার থাকব।” 

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি তাপস হোড় বলেন, “ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত যাত্রামোহন সেনগুপ্ত, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত এবং নেলী সেনগুপ্তার স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়ি। সেই বাড়ি ভূমিদস্যুরা ভাঙতে উদ্যত হয়েছে।

“ভাঙা ঠেকানো গেলেও ভূমিদস্যুরা এখনো ওই বাড়িতে অবস্থান করছে। সরকারের কাছে দাবি অনতিবিলম্বে ভূমিদস্যু সন্ত্রাসীদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করে বাড়িটি জাদুঘর করা হোক এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। আমাদের প্রত্যাশা সরকার এই মানবিক উদ্যোগটি দ্রুত গ্রহণ করবে।”

ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক মিটুল দাশগুপ্ত বলেন, “কিছু ভূমিদস্যু এবং একশ্রেণির দালাল স্বাধীনতা বিরোধী মিলে যাত্রামোহন সেনের বাড়িটি আত্মসাতের পায়তারা করছে। চট্টগ্রামের প্রগতিশীল মানুষ বাড়িটি রক্ষায় সোচ্চার হয়েছেন। স্পষ্টভাবে বলতে চাই গুটিকয়েক ধান্ধাবাজ যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে বাড়িটি রক্ষা করতে হবে।”

সাংস্কৃতিক সংগঠক ও প্রমার সভাপতি রাশেদ হাসান বলেন, “আমরা বলি সূর্যসেনের- প্রীতিলতার বীর চট্টলা। কিন্তু তাদের কোনো স্মৃতিই আমরা সংরক্ষণ করতে পারিনি। এমনকি পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাবটিও জাদুঘর করা হয়নি।

“চট্টগ্রামের একটি বধ্যভূমিও যথাযথ মর্যাদায় রক্ষা করতে পারিনি। কতিপয় ভূমিদস্যু বাড়িটি দখল করে এর সামনের অংশ ভেঙে ফেলেছে। প্রতিবাদের মুখে তারা দখল কাজ হয়ত বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। চট্টগ্রামে কোনো নিদর্শন কোনো স্থাপনা দখলের পায়তারা করলে অবশ্যই নাগরিকরা আন্দোলনে সামিল হবে।”

সাংবাদিক প্রীতম দাশের সঞ্চালনায় সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন সাংবাদিক প্রদীপ দেওয়ানজী, অধ্যক্ষ সুকুমার দত্ত, অ্যাডভোকেট চন্দন বিশ্বাস, নাট্য ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল যাত্রা, সাংস্কৃতিক সংগঠক সুনীল ধর, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পালিত, কাজল চৌধুরী, ছাত্র যুব ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রুবেল পাল, ওয়ার্কার্স পার্টির চট্টগ্রাম জেলার সদস্য সুপায়ন বড়ুয়া, সংগঠক শিমুল দত্ত, সিপিবি জেলা কমিটির সদস্য প্রদীপ ভট্টাচার্য্য, হিন্দু সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি প্রদীপ দে, শৈবাল পারিয়াল, ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি এ্যানি সেন, বিপ্লব ঘোষ প্রমুখ।

ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত রহমতগঞ্জে ১৯ গণ্ডা জমির উপর এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত।

ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহনও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়রও হয়েছিলেন। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় এই বাড়িতে এসেছিলেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও এই বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। এতে ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়ে ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যু হয়েছিল যতীন্দ্রমোহনের।

ওই জমিটি পরে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষিত হয়। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি জমিটি ইজারা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

তবে যাত্রামোহনের এক স্বজনের কাছ থেকে কেনার দাবি করে আদালতের একটি আদেশ নিয়ে সোমবার বাড়িটি ভাঙতে যায় একটি পক্ষ, স্থানীয়দের নিয়ে যা ঠেকিয়ে দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।