নাছিয়া ঘোনার সেই নুরুর সাজার রায় জানে না পুলিশ

নাছিয়া ঘোনার নূরে আলম নুরুকে হন্যে হয়ে চট্টগ্রাম পুলিশ খুঁজলেও তার বিরুদ্ধে যে দেড় বছর আগে একটি সাজার রায় রয়েছে, তার হদিস নেই থানার নথিতে; অথচ পুলিশই মামলাটি করেছিল।

চট্টগ্রাম ব্যুরোউত্তম সেনগুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2021, 03:49 AM
Updated : 6 Jan 2021, 04:40 AM

চট্টগ্রামের পূর্ব ফিরোজশাহ কলোনির নাছিয়া ঘোনা এলাকায় সব অপকর্মের ‘হোতা’ নুরুর বিরুদ্ধে পাহাড় কাটা, কাঠ পাচার, মাদক বিক্রিসহ নানা অভিযোগে ২৮টি মামলার খবর আছে পুলিশের কাছে।

একটি অস্ত্র মামলায় ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৬ এর বিচারক মুহাম্মদ ছালামত উল্লাহ আসামি নুরুকে ১০ বছর ও ৭ বছর করে মোট ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেন। 

মামলার নথি অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৬ জুলাই নুরুকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছিল আকবর শাহ থানা পুলিশ। পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করে। তবে জামিনে বেরিয়ে আসা নুরু রায়ের সময় ছিলেন পলাতক।

রায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আকবর শাহ থানার ওসি জহির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালত থেকে যেসব পরোয়ানা আসে, তা থানার নিবন্ধন বইতে লিপিবদ্ধ থাকে। কিন্তু ২০১৯ ও ২০২০ সালের নিবন্ধন বইতে নুরে আলম ওরফে নুরুর বিরুদ্ধে জারি হওয়া সাজা পরোয়ানার কিছু উল্লেখ নেই।”

ওসি জানান, নুরুর বিরুদ্ধে আকবর শাহ ও খুলশী থানায় হওয়া ২৮টি মামলার তথ্য তাদের আছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ছয়টি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থানায় রেকর্ড থাকলেও কোন সাজা পরোয়ানা রেকর্ড নেই।

মামলার নথিতে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ৬ জুলাই রাতে আকবর শাহ থানার পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনি এলাকা থেকে নুরুকে একটি দেশীয় এলজি ও চার রাউন্ড কার্তুজসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি একনলা বন্দুক, ছুরিও উদ্ধার করে।

এ ঘটনায় এসআই সেলিম মিয়া বাদী হয়ে আকবর শাহ থানায় নুরুর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করেন। এসআই মো. মনির মামলাটির তদন্ত করে একই বছরের ৭ অগাস্ট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।

মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে জমা দেয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করে তা বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠান। পরের বছরের ৪ অগাস্ট আদালত অভিযোগ গঠন করে মামলাটির বিচারের জন্য প্রস্তুত করে। ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই রায় হয়।

দেড় বছরের বেশি সময়েও সাজা পরোয়ানা থানায় না পৌঁছানোর বিষয়টি নিয়ে ট্রাইবুন্যালের অতিরিক্ত পিপি আখতারুন্নেসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়ম হলো রায় ঘোষণার পর আদেশ সেকশনে যায়। সেখান থেকে যায় ডেসপাস শাখায়। এটা পুলিশের লোকজন দেখে, প্রসিকিউশন দেখে।

(চট্টগ্রামের পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনির নাছিয়া ঘোনা ১ নম্বর ঝিল এলাকায় এতিমখানার নামে কাটা হচ্ছে পাহাড়, যা নুরে আলম নুরুই করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।  ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত)

“কেন কাদের কারণে সাজা পরোয়ানা পৌঁছল না, সেটা আমরা জানি না। সাজা পরোয়ানা যায়নি, এটা আপনার কাছ থেকে জানলাম। আগামীকাল আদালতের কাছে লিখিত আবেদন করে নতুন সাজা পরোয়ানা ইস্যু করাব। এরপর সেই সাজা পরোয়ানা আমরা থানার ওসির কাছে পাঠাব। আশা করি, কয়েকদিনের মধ্যে সব করতে পারব। তখন আপনাকে জানাব।”

এই মামলার রায় ঘোষণার জন্য ‘আপ্রাণ’ চেষ্টা চালিয়েছিলেন দাবি করে এই আইনজীবী বলেন, “বিচার বাধাগ্রস্ত করতে নুরু নানাভাবে চেষ্টা করেছে। বারবার উচ্চ আদালতে গেছে নানা অজুহাতে।

“শুরু থেকে স্থানীয় (আকবর শাহ) একটি দালাল চক্র তাকে রক্ষায় সক্রিয় ছিল। মামলায় জেরা শুরু হলে তারা আবার হাই কোর্টে যায়। এরপর সেই প্রক্রিয়া শেষে হলে আমাদের সেসময়ের বিচারক প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে যান। এরপর নতুন বিচারক যোগ দেন। যুক্তিতর্কের সময়ও আইনগতভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে।”

আকবর শাহ থানার ওসি জহির হোসেন বলেন, “যেহেতু নুরুর বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা হলেও তা থানায় পৌঁছেনি, আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সংশ্লিষ্ট আদালতের নজরে আনারও প্রক্রিয়া করছি।”

নাছিয়া ঘোনা ১ নম্বর ঝিলের বাসিন্দা নুরুর বিরুদ্ধে রয়েছে হরেক রকমের অভিযোগ। রেলওয়ের মালিকানাধীন পাহাড় কেটে নুরু তৈরি করেছেন বসতি, দেশি-বিদেশি কবুতর, গরু, ছাগল, ভেড়ার খামার।

এছাড়া তিনি পাহাড় কেটে বিভিন্ন স্থানে লাগিয়েছেন কবরস্থানের সাইনবোর্ড, এতিম খানা, মসজিদ তৈরি করলেও সেখানে দেখা মেলেনি এতিম কিংবা কোনো মুসল্লি কিংবা ইমামের।

গত বছরের ২৪ জুন ও ২২ অগাস্ট দুই দফায় সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রেলের মালিকানাধীন ওই জমিতে পাহাড় কেটে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা আমরা দেখতে পাই। এরমধ্যে ১ নম্বর ঝিল পাড় এলাকায় নুরুর এসব স্থাপনাও ছিল।”

গত ২৫ ডিসেম্বর নুরুকে ধরতে নাছিয়া ঘোনায় অভিযানে গেলে সেখানে পুলিশের উপর হামলা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে নুরুর এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করলেও পালিয়ে যান তিনি। এরপর ৩১ ডিসেম্বর ভোরে অভিযান চালিয়ে নুরুর ১২ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর ৪ জানুয়ারি তৃতীয় দফায় নাছিয়া ঘোনায় অভিযান চালিয়েও তাকে ধরতে পারেনি।

অভিযোগ রয়েছে, নাছিয়া ঘোনা এলাকায় নুরুর পরিবারের সদস্যরা নিয়ন্ত্রণ করেন পুরো সন্ত্রাসী কার্যক্রম। নুরুর মতো তার ভাই জানে আলমও সেখানে পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তুলেছেন।

নুরুর স্ত্রী, তার ভাই জানে আলমের স্ত্রী ও বোন রুবি তাদের অনুসারী পরিবারের নারীদের নিয়ে পুলিশের উপর ইট ছোড়ে বলে জানান স্থানীয় কয়েকজন। নুরুর স্ত্রী ও বোন সেখানে ‘ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন’ বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নুরুকে দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও। সম্প্রতি একটি ছবি প্রকাশ পায় আকবর শাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ হোসেনের সঙ্গে।

তবে এ ছবিটি বানানো দাবি করে আলতাফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে (নুরু) বিএনপি’র লোক। এলাকায় অনেক কু-কর্মের সাথে জড়িত। হয়ত কোথাও দেখিয়ে সুবিধা নেওয়ার জন্য সে (নুরু) এ ছবিটি কম্পিউটারে তৈরি করেছে।”

আরও পড়ুন