দিয়াজ হত্যা গড়ায়নি বিচারে, ‘পলাতক’ আসামিরা প্রকাশ্যে

চার বছর পেরিয়ে গেলেও ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি বলে বিচারও শুরু হয়নি।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীও আজহারুল ইসলাম জুয়েল, চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2020, 06:11 AM
Updated : 20 Nov 2020, 06:12 AM

তার পরিবারের অভিযোগ, মামলার আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও তদন্তকারী সংস্থার কোনো আগ্রহ নেই আসামিদের গ্রেপ্তারে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) প্রায় তিন বছর ধরে মামলাটির তদন্ত করছে। এর মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে তিন বার।

তদন্ত এখনও শেষ না হলেও ‘অগ্রগতি আছে’ বলে দায়সারা বক্তব্য এসেছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।

২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসে নিজের বাসা থেকে উদ্ধার হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ।

ঘটনার তিন দিন পর ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের দেওয়া প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ উল্লেখ করা হয়। তার ভিত্তিতে হাটহাজারী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করে পুলিশ।

(আসামি আলমগীর টিপুর একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিতির ছবি দিয়ে হতাশাভরে লিখেছেন দিয়াজের বোন জুবাঈদা ছরওয়ার চৌধুরী নিপা)

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্মাণ কাজের দরপত্র নিয়ে কোন্দলের সূত্র ধরে এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যা’ বলে শুরু থেকেই দিয়াজের পরিবার ও তার অনুসারী ছাত্রলীগের কর্মীরা দাবি করে আসছিল।

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ওই বছরের ২৪ নভেম্বর দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বাদী হয়ে আদালতে হত্যা মামলা করেন।

তাতে চট্টগ্রাম বি শ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সেসময়ের সভাপতি আলমগীর টিপু, সেসময়ের সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, তাদের অনুসারী রাশেদুল আলম জিশান, আবু তোরাব পরশ, মনসুর আলম, আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমানকে আসামি করা হয়।

আসামিরা সবাই চট্টগ্রামের সদ্য সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দিয়াজও ছিলেন নাছিরেরই অনুসারী।

দিয়াজের মায়ের আপত্তিতে আদালত সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়।

এরপর দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা। এজন্য তখন তারা চট্টগ্রামে দিয়াজের লাশ উদ্ধারের স্থানেও যান। 

২০১৭ সালের ৩০ জুলাই দেওয়া দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তারা বলেন, দিয়াজের শরীরে হত্যার আলামত রয়েছে। ওই প্রতিবেদনের পর দিয়াজের মায়ের করা এজাহার হত্যা মামলা হিসেবে নিতে হাটহাজারী থানার ওসিকে নির্দেশ দেয় আদালত।

দিয়াজের বোন আইনজীবী জুবাঈদা ছরওয়ার চৌধুরী নিপা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চার বছর চলে গেল, তদন্ত প্রতিবেদন এখনও জমা দেওয়া হয়নি। প্রায় তিন বছর ধরে মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। এরমধ্যে তিনবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন।

“দু’জন আসামি জামিনে আছে। বাকিদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট থাকলেও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা প্রকাশ্যে ঘুরছে। একজন আসামিকেও গ্রেপ্তার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করাতে পারেনি পুলিশ।”

১১ নভেম্বর ফেইসবুকে এই মামলার আসামি আলমগীর টিপুর ছবিসহ একটি স্ট্যাটাস দেন জুবাঈদা। তাতে দেখা যায় যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত টিপু।

স্ট্যাটাসে জুবাঈদা লেখেন, “দিয়াজ হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি এবং সিআরবি ডবল মার্ডার মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আলমগীর টিপুর আজকের ছবি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার চোখে এখন যে পলাতক…..। ক্ষমতার কাছে মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় লাগে।”

জুবাঈদা বলেন, “যুবলীগের এক অনুষ্ঠানে আসামি টিপুকে দেখা গেছে। নগরীতে তার অফিসও আছে বলে শুনেছি। কী আর বলব। চার বছর গেল, কোনো অগ্রগতি নেই। অমার মায়ের শারীরিক-মানসিক অবস্থা খুব নাজুক।”

একই ছবি দিয়ে ১৩ নভেম্বর ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী লেখেন, “খুনিরা ক্ষমতা ও টাকার জোরে বহাল তবিয়তে ঘুরছে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। আর আমি ক্ষমতা ও টাকার কাছে হেরে অসহায়ের মত তাদেরই ব্যঙ্গ সহ্য করেই….”।

ইরফান চৌধুরী দিয়াজ

১৫ নভেম্বর দিয়াজের পুরনো কয়েকটি ছবিসহ ফেইসবুকে দিয়ে জাহেদা আমিন চৌধুরী লেখেন, “হায় আল্লাহ, তুমিই বলো আমার বাবারা ১৯৭১ সালে জীবন বাজিয়ে দেশ কেন স্বাধীন করেছিল? এমন আফসোস মন থেকে কে তাড়াবে।”

মামলার অগ্রগতি ও আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস সালাম মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্ত চলছে। আসামিদের দু’জন গ্রেপ্তারের পর জামিনে আছেন। বাকিরা পলাতক।

“তদন্তে অগ্রগতি আছে।”

তবে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন কবে নাগাদ জমা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানাতে পারেননি তিনি।

আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে, দিয়াজের পরিবারের এমন দাবির বিষয়ে সিআইডি কর্মকর্তা আবদুস সালাম মিয়া বলেন, “সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য থাকলে অবশ্যই তাদের ধরবো। এখনো সেরকম কোনো তথ্য পাইনি।”

সিআইডি চট্টগ্রামের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শাহনেওয়াজ খালেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি সম্প্রতি এখানে যোগ দিয়েছি। এরআগে হাটহাজারী থানার ওসিসহ অনেকে তদন্ত করেছেন।

“এটি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হত্যা মামলা। শনিবার আমি ঘটনাস্থলে যাব।”

মামলার আসামি সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরী একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ১০ নভেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওই মামলায় জামিনের আবেদন করলেও ১৭ নভেম্বর আবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সময়ের আবেদন করলে জামিন শুনানি পিছিয়ে যায়। 

অন্যান্য আসামিদের মধ্যে মনসুর আলম ও আবদুল মালেকের বিরুদ্ধে চলতি বছর ২৩ জুন বিশ্ববিদ্যালেয়ে নির্মাণকাজে বাধা দেওয়া ও ঠিকাদার অফিস ভাংচুরের অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ব্যানারে নানা অনুষ্ঠানে এজহারভুক্ত অন্যান্য আসামিদেরও দেখা যায়।

নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে দিয়াজের এক অনুসারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দিয়াজ ভাইকে হত্যা করা হয়েছে চার বছর আগে। কিন্তু চার বছরেও আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা আসামি হয়েও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়ায়।"

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে হল ত্যাগের নির্দেশনা দেওয়ার পর মনসুর আলম ও আবদুল মালেক ক্যাম্পাসের সীমানা লাগোয়া একটি ভবনে থাকেন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ড. আতিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন অপরাধীকে ছাড় দেবে না

“আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য নিয়ে ক্যাম্পাসে অভিযান পরিচালনা করে সেক্ষেত্রে তাদের সর্বোচ্চ সহযোগীতা করা হবে।”