গর্ভপাতে মৃত তরুণীকে কোভিড-১৯ রোগী বলেছিল সিটি ক্লিনিক

চট্টগ্রামে সিলগালা করে দেওয়া সিটি হেলথ ক্লিনিক ছয় মাস আগে অবৈধ গর্ভপাত করাতে গিয়ে মারা যাওয়া এক তরুণীকে কোভিড-১৯ রোগী বলে প্রচার করেছিল বলে দাবি করেছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2020, 12:32 PM
Updated : 12 Nov 2020, 12:32 PM

বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ এ তথ্য জানায়।

বুধবার রাতে সিলগালা করার আগে পুলিশ হাসপাতালটির পরিচালক হারুনর রশিদ (৬০), নার্স গীতা দাশ (৪৩) ও আয়া সাবিনা ইয়াসমিন ওরফে চম্পাকে (৪৩) গ্রেপ্তার করে।

এর আগে সকালে অলকা পাল (৩২) নামের এক নার্সকে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

গত ১৫ মে নগরীর চকবাজার এলাকায় সিটি হেলথ ক্লিনিকে অবৈধ গর্ভপাত করাতে গিয়ে মৃত্যু হয় এক তরুণীর। মৃত্যুর ১১ দিন পর পরিবারের অভিযোগে মামলা নেয় চকবাজার থানা পুলিশ। এর প্রায় ছয় মাস পর তদন্ত শেষে বুধবার রাতে হাসপাতালটি হাসপাতালটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি-দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান বলেন, গত ১৫ মে সিটি হেলথ ক্লিনিকে মৃত্যু হয় এক তরুণীর। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই তরুণী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে পরিবারকে লাশ বুঝিয়ে দেয়।

“এর ১০ দিন পর ২৬ মে ওই তরুণীর বাবা চকবাজার থানায় এসে অভিযোগ করেন তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় ওই তরুণীর সেজান নামের এক বন্ধু এবং অন্য এক যুবককে আসামি করা হয়।”

তিনি বলেন, “মামলার পর সেজানকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে জানায় ওই তরুণীর গর্ভপাত করানোর জন্য সিটি হেলথ ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়েছিল, সেখানে সে মারা যায়। তবে এজন্য সে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তবে বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা অস্বীকার করে হাসপাতালে কেউ মারা যায়নি বলে দাবি করে। আটক সেজানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপার্দ করা হলে সে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।”

ডিসি মেহেদী বলেন, “মামলার পর ওই তরুণীর কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে ময়না তদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। পাশাপাশি আমরা ওই তরুণীর লাশ নিয়ে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সটি খুঁজতে থাকি। জুন মাসের মাঝামাঝি ওই অ্যাম্বুলেন্সের সন্ধান পেয়ে চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেও সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়ে লাশ নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে।

“হাসপাতালেই তরুণীর মৃত্যু হয়েছে সেটি নিশ্চিত হয়ে বুধবার অলকা পাল (৩২) নামে হাসপাতালের এক নার্সকে আটক করা হয়। সে আদালতে জবানবন্দিতে জানায় ওই তরুণীর গর্ভপাত করাতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। মেয়েটির শারিরীক অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসক ডাকার কথা বলা হলেও হাসপাতাল পরিচালক ডাকেননি।”

তিনি জানান, অলকার জবানবন্দির পর রাতেই হাসপাতাল পরিচালক হারুনর রশিদ, নার্স গীতা দাশ ও আয়া সাবিনা ইয়াসমিন ওরফে চম্পাকে গ্রেপ্তার করা হলে তারা অবৈধ গর্ভপাতে ওই তরুণীর মৃত্যুর কথা স্বীকার করে।

“তখন বিষয়টি সিভিল সার্জনকে অবহিত করা হলে তিনি হাসপাতালে এসে কাগজপত্র দেখেন এবং কর্তৃপক্ষ কোনো অনুমোদন দেখাতে না পারায় হাসপাতালটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।”

ডিসি মেহেদী হাসান জানান, অভিযানে হাসপাতাল পরিচালকের কাছ থেকে কাগজপত্র দেখতে চাওয়া হলে তিনি ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারেননি। ওই হাসপাতালটিতে কর্মরত নার্সদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। কোনো অভিজ্ঞ চিকিৎসকও নেই। দিনে ডাক্তার থাকলেও রাতে তারা দায়িত্ব পালন করেন না।

অভিযানে হাসপাতালে ছয়জন রোগী পাওয়া যায়, যাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

গর্ভপাতে মারা যাওয়া তরুণীর পরিবারের পক্ষ থেকে যে দুইজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তার একজন মেয়েটির বন্ধু সেজান। অপরজন সেজানের বন্ধু। কিন্তু পুলিশের তদন্তে এ ঘটনায় সেজানের বন্ধুর সম্পৃক্ততা না মেলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে জানান ডিসি মেহেদী।

মামলায় সেজান এবং তদন্তে আসা হাসপাতালের নার্স, আয়া ও পরিচালককে আসামি করা হয়েছে।

মৃত তরুণীর ছোট বোন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার বোন নগরীর একটি কলেজ থেকে বিবিএস শেষ করে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। পাশাপাশি একটি ডেটা এন্ট্রি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। সেজানও তার সাথে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তবে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল না বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি জানান, দুই বোন এক সাথে নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় থাকতেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি বাড়িতে চলে গেলেও তার বোন বাসায় একা ছিলেন।

“১৪ মে আমার বোন ফোন করে পরদিন রাঙ্গুনিয়ার বাড়িতে যাওয়ার কথা জানায়। কিন্তু বিকাল পর্যন্ত বাড়ি না যাওয়ায় আমি তার মোবাইলে ফোন করলে সেজান কল ধরে জানায় আমার বোন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।”

ওই তরুণীর বাবা বলেন, মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি ও তার স্ত্রী সিটি হেলথ ক্লিনিকে আসেন। তখন তারা লাশটি কাপড় মোড়ানো অবস্থায় দেখতে পান।

“আমরা মেয়েকে ধরতে চাইলে তারা আমাদের ধরতে না দিয়ে জানায় আমাদের মেয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তবে বিষয়টি আমরা নার্স অলকার কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি জানান আমার মেয়েকে হাসপাতালে আনার পর সে মাথা ঘুরে পড়ে যায় এবং তাকে দেখে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু হাসপাতালের দারোয়ান আমাদের জানায় আমার মেয়ে সকালে সেখানে গেছে এবং বিকালে মারা যায়।

“হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে মৃত্যু সনদ চাওয়া হলেও তারা দেয়নি। তাদের বিভ্রান্তিমূলক কথা শুনে আমদের সন্দেহ হলেও চকবাজার এলাকা থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে লাশ বাড়িতে নিয়ে যাই।”

তবে মৃত তরুণীর বোনের দাবি, লাশ গোসল করানোর সময় বোনের মাথার পেছনে থেঁতলানো এবং রক্তাক্ত দেখতে পেয়েছেন। এছাড়াও তার দুই হাতে কামড়ের দাগ দেখেছেন। 

এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডিসি মেহেদী হাসান বলেন, আদালতের নির্দেশে লাশ উত্তোলন করা হয়েছে দাফনের অন্তত ১৫ দিন পর। এসময় লাশটি বিকৃত হয়ে গেছে।

লাশের ময়না তদন্তের প্রতিবেদন এখনও পাননি বলে জানান ডিসি মেহেদী।