প্রায় ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা ট্রাংক রোডের ফৌজদারহাট অংশ থেকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণে দুই পাশে ৯০ ডিগ্রি খাড়া করে এসব পাহাড় কাটে সিডিএ। এভাবে কাটায় এখন যে কোনো সময় পাহাড়গুলো ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
শুক্রবার ভারী বৃষ্টির পর ওই সড়কের কয়েকটি স্থানে সংলগ্ন পাহাড়ের অংশ বিশেষ ধসেও পড়েছে।
ইচ্ছেমতো পাহাড় কাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরের বড় অঙ্কের জরিমানা ও নির্দেশনার পর রাস্তার দুইপাশে থাকা এসব পাহাড় আবার নতুন করে কেটে ‘ঝুঁকি কমানোর’ প্রস্তাব দিয়েছে সিডিএ।
“আমাদের প্রস্তাবনায় ওয়ান ইজ টু ওয়ান অর্থা ৪৫ ডিগ্রি স্লোপে কাটার কথা বলা হয়েছে। যদি এর কম স্লোপ রেখে কাটা হয় তাহলে সেখানকার বেশিরভাগ পাহাড় টিকবে না। ওই পাহাড়ের মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি।”
প্রায় তিন মাস আগে সিডিএ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব দেওয়া হলে তা মেনে নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর।
“আনুষ্ঠানিকভাবে রাস্তাটি উদ্বোধন না হলেও এর একপাশ খোলা। তাতে উভমুখী যান চলাচল করছে। বর্ষায় এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। দর্শনীয় হওয়ায় সেখানে অনেকে বেড়াতেও যান। তাই ঝুঁকিটা আরও বেশি।”
নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও সড়কটি পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য মাসখানেক আগে খুলে দেওয়া হয়েছে।
পাহাড় নিয়ে এই ‘অনাচারে’ ক্ষোভ জানিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন পিপল’স ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুরুতে নির্দেশনা মেনে রাস্তাটি নির্মাণ করলে পাহাড়গুলো এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠত না। নতুন করে পাহাড়ও কাটতে হত না। এখন উচিত দ্রুততম সময়ে পাহাড়গুলোর সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। তা না হলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনায় বড় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।
“ওই এলাকায় রাস্তার দুই পাশে নানা ব্যক্তি ও সংগঠনের নামে বিভিন্ন কায়দায় পাহাড় দখল চলছে। রিটার্নিং ওয়ালসহ সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় এটা চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত সেখানে পাহাড় কাটা বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা।”
“পরিবেশ অধিদপ্তরের গাইড লাইন ভেঙে পাহাড় কেটে সড়ক করায় বৃষ্টিতে ভূমিধস হয়ে চলাচলকারী পণ্যবাহী যানবাহন ও মানুষ মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়তে পারে উল্লেখ করে ৭ জুন একটি প্রতিবেদন উর্ধতন কর্তৃপক্ষ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরে জমা দিয়েছি।”
এরপর পরিবেশ অধিদপ্তর সিডিএ’র সাথে যৌথভাবে সার্ভে করে।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিদর্শন শেষে আমরা প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। পরে আরও কিছু বিষয় জানতে চাইলে চূড়ান্ত করে চলতি মাসে আবার পাঠিয়েছি।
২০১৬ সালের জুনে ১৭২ কোটি ৪৯ লাখ টাকার এই লিংক রোড প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুরুতে দুই লেনের সড়ক করার কথা থাকলেও ২০১৬ সালের অক্টোবরে সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়। এতে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২০ কোটি টাকা।
২০১৬ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিলেও সে অনুযায়ী কাজ না করে পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতি করায় ২০১৭ সালে সিডিএকে দুই দফায় নোটিশ দেওয়া হয়। জরিমানা করা হয় ১০ লাখ টাকা।
এরপরও পাহাড় কাটা থামেনি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নগরীর উত্তর পাহাড়তলি মৌজা, হাটহাজারীর জালালাবাদ মৌজা এবং সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর মৌজায় প্রায় ১৮টি পাহাড় কাটা হয় বলে অভিযোগ।
চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে শুনানি শেষে ‘পাহাড় কেটে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, পাহাড়ের উপরিভাগের মাটি ও ভূমির বাইন্ডিং ক্যাপাসিটি নষ্টসহ পরিবেশ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করায়’ সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
পাশাপাশি হিল কাটিং ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানের নির্দেশনা না মেনে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে খাড়া করে পাহাড় কাটার প্রমাণ মেলে।
৬ ফেব্রুয়ারি পরিদর্শনে এসে পরিবেশমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিনও জানান, যে স্লোপ রাখার কথা ছিল তা রাখা হয়নি।
এরপর মহামারীর সুযোগ নিয়ে নির্মাণাধীন সড়কের দুই পাশের এসব পাহাড়ের পাদ দেশে সরকারি-বেসরকারি মালিকানার প্রায় ১৫ একর পাহাড় ও টিলা কেটে চারশ’র বেশি স্থাপনা গড়ে তোলে দখলদাররা। পরে সেখানে উচ্ছেদ অভিযানও চালিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এই সড়কটির কাজ শেষে পুরোপুরি চালু হলে কাপ্তাই, রাঙামাটি, হাটহাজারী, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া থেকে আসা যানবাহন নগরীতে প্রবেশ না করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠতে পারবে।
আরও পড়ুন