সুদীপ্ত হত্যা: বিচারের অপেক্ষায় ৩ বছর

চট্টগ্রামের ছাত্র লীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। সত্তরের কোঠায় থাকা মেঘনাথ বিশ্বাসের একটাই আকুতি, ছেলে হত্যার বিচার যেন দেখে যেতে পারেন তিনি।

উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2020, 04:49 PM
Updated : 5 Oct 2020, 06:48 PM

মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, তদন্ত শেষ পর্যায়ে। এই মাসের মধ্যেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।

হত্যার ‘হুকুমদাতা’ আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম মাসুমসহ গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কাউকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকের মাঝে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অভিযোগপত্রে কাদের আসামি করা হচ্ছে জানতে চাইলে সরাসরি উত্তর না দিয়ে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈনুদ্দীন বলেন, “আমরা সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করিনি। যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারা বিভিন্নভাবে অভিযুক্ত এ হত্যাকাণ্ডের সাথে। সুতরাং সবাইকে আসামি করা হচ্ছে।”

২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর সকালে দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয় নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে। মঙ্গলবার হত্যাকাণ্ডের তিন বছরপূর্তি হচ্ছে।

সুদীপ্তর বাবা মেঘনাথ বিশ্বাস বাদি হয়ে সদরঘাট থানায় অজ্ঞাত সাত-আটজনকে আসামি করে যে হত্যা মামলা করেছিলেন, এক বছর পর তারই আবেদনে আদালত এর তদন্তের দায়িত্ব পিবিআইকে দেয়।

হত্যাকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগের একাংশ লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুমকে দায়ী করলেও গ্রেপ্তারকৃতদের কারও জবানবন্দিতে তার নাম আসেনি; এক ‘বড় ভাই’ হুকুমদাতা ছিলেন বলে তাদের ভাষ্য।

গত বছরের ১২ জুলাই গ্রেপ্তার মিজান হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে মাসুমের নাম বলার পর গ্রেপ্তার হন মাসুম। তিনি ছাড়াও এ মামলায় আরও ১৭ গ্রেপ্তার হয়েছেন, যারা সবাই মাসুমের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়েছেন। এদের মধ্যে চার জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুদীপ্তকে পিটিয়ে মারার যে ভিডিওটি মোক্তারের কাছে পাওয়া গিয়েছিল সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে।

“যেহেতু মোক্তার জামিনে আছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি তার করা ভিডিওটি সে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে যাদের পাঠিয়েছিল সেটির ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষার প্রয়োজন। ১২ অক্টোবর এ নিয়ে আদালতে শুনানি আছে।”

এই প্রতিবেদন আসার পরই অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে বলে জানান সন্তোষ।

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক মামলায় প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষ্য দিতে চায় না। আমরা তদন্তের সময় ঘটনাস্থল এবং আশেপাশের এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু কেউ সে বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি।”

পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, লালখান বাজার এলাকা থেকে আটটি অটোরিকশা করে দক্ষিণ নালাপাড়া গিয়েছিল হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা। পিবিআই মামলার তদন্তভার নেওয়ার পর সাতটি অটোরিকশা জব্দ করে। জব্দ করা হয়েছে একটি মটরসাইকেলও।

এসব অটোরিকশা চালকদের মধ্যে তিন জন সাক্ষী হিসেবে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

পরিদর্শক সন্তোষ বলেন, “যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। তাই এই মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণের জন্য আমরা তথ্যপ্রযুক্তির ওপর জোর দিচ্ছি।

“ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ, জড়িতদের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও, কথোপকথনের অডিও এবং বিভিন্ন ফরেনসিক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অভিযোগপত্র তৈরি করা হচ্ছে।”

এ মামলায় মাসুমের নাম আসার কিছু দিন পর গত বছরের ২২ জুলাই অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর এফ কবির মানিক।

তার আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ৩১ জুলাই মাসুমের দুটি অস্ত্রের নিবন্ধন বাতিল করে আদেশ জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ৩ অগাস্ট বিকালে মাসুম নিজে গিয়ে নিবন্ধন বাতিল করা তার অস্ত্রগুলো খুলশী থানায় জমা দিয়েছিলেন।

পরদিন ঢাকার বনানী থেকে মাসুমকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তিনি এখন জামিনে আছেন।

চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি থাকার সময় মাসুম প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে ২০১৪ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের বলয়ে চলে আসেন। মাঝে তিনি সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীনের পক্ষের লোক হিসেবেও নিজেকে পরিচয় দিতেন।

সুদীপ্ত বিশ্বাসের বাবা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বরগুনার রিফাত হত্যার বিচার এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বুয়েটের আবরার হত্যা মামলার বিচার কাজও শেষ দিকে। কিন্তু তিন বছরে আমার ছেলে হত্যার অভিযোগপত্রও জমা হয়নি।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক তার জীবদ্দশায় ছেলে হত্যার বিচার দেখে যাওয়ার আশায় বসে আছেন।

তাই অভিযুক্তরা প্রভাবশালী বলে তারা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে কোনভাবে বেরিয়ে যেতে না পারে এ ব্যাপারে সরকারসহ প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

আরও পড়ুন