আহমদ শফী তার শত বছরের জীবনের অর্ধেকটাই পার করেছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায়। দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত দেশের অন্যতম পুরনো এ কওমি মাদ্রাসাকে স্থানীয়রা চেনেন হাটহাজারীর ‘বড় মাদ্রাসা’ হিসেবে। আর ১৯৮৬ সাল থেকে সেই মাদ্রাসার মহাপরিচালকের (মুহতামিম) দায়িত্ব পালন করে আসা শফী ছিলেন তার অনুসারীদের কাছে ‘বড় হুজুর’।
মাদ্রাসার শূরা কমিটির সদস্য ও নানুপুর মাদ্রাসার মহাপরিচালক সালাউদ্দিন নানুপুরীর ভাষায়, “আল্লামা আহমদ শফী ছিলেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বড় মুরুব্বি ও আলেম। কওমি মাদ্রাসা ঘরানায় তার মত বড় ব্যক্তি আর নেই।”
ধর্মীয় পাণ্ডিত্যের কারণে সমমনা আলেম আর কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাছে আহমদ শফী ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। তবে বহু মতে বিভক্ত বাংলাদেশের কওমি ধারাগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে পারা ছিল তার বড় কৃতিত্ব। এর মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশের কওমি ধারার আলেমদের শীর্ষ নেতা।
পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে মারা যান হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী।
তার ছাত্র ও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় হুজুর ছিলেন সারা দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর সর্বোচ্চ শিক্ষাগুরু। নাস্তিক্যবাদী আন্দোলনসহ বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ রূপকার তিনি।
“ইসলামী সমাজ ও সাংস্কৃতিক চেতনা সৃষ্টিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বহুমুখী অবদান রেখেছেন।”
কওমি ধারার এই ‘আধ্যাত্মিক নেতাকে’ ঘিরে বিতর্কের কারণগুলো আজিজুল হক ইসলামাবাদীর বক্তব্যের মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়।
নারী শিক্ষার বিরোধিতা, বিতর্কিত নানা মন্তব্য, ব্লগারদের ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে শাস্তি ও পাঠ্যসূচি পরিবর্তনের দাবি এবং বাঙালি সংস্কৃতির নানা অনুসঙ্গ ও প্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে গত এক দশকে তিনি সমালোচিত হয়েছেন বার বার।
তার বাবার নাম বরকম আলী, মা মোছাম্মাৎ মেহেরুন্নেছা বেগম। আহমদ শফী দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক।
তার দুই ছেলের মধ্যে আনাস মাদানি হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। অন্যজন মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ পাখিয়ারটিলা কওমি মাদ্রাসার পরিচালক।
শফীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায়। এরপর পটিয়ার আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদ্রাসায় (জিরি মাদ্রাসা) লেখাপড়া করেন। ১৯৪০ সালে তিনি হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় যান, সেখানে চার বছর লেখাপড়া করেন।
আহমদ শফী হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে যোগ দেন ১৯৮৬ সালে। এরপর টানা ৩৪ বছর ওই পদে ছিলেন বাংলায় ১৩টি এবং উদুর্তে নয়টি বইয়ের রচয়িতা এই আলেম।
শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, যাতে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও যুক্ত হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠাই হেফাজতের আন্দোলনের লক্ষ্য।
যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে সেই আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক ব্লগার’ আখ্যায়িত করে তাদের শাস্তির দাবিতে সক্রিয় হয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি।
ওই দাবিটি সামনে রেখেই তারা সে সময় ১৩ দফা দাবিতে ন্দোলন শুরু করে, যার মধ্যে কয়েকটিকে ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ বলেন তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
‘ইসলামবিরোধী’ নারীনীতি, ‘ধর্মহীন’ শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করারও দাবি ছিল সেখানে।
যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরোধিতা করায় হেফাজতকে সে সময় ‘একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মা’ বলে আখ্যায়িত করেন আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এ সংগঠনকে তিনি ‘আল-বদর’ ও ‘রাজাকারদের’ উত্তরসূরিও বলেছিলেন।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট এবং এইচ এম এরশাদের দল জাতীয় পার্টিও সে সময় হেফাজতের কর্মসূচিতে সমর্থন দেয়।
শাপলা চত্বরে ওই অবস্থান ঘিরে দিনভর পুলিশের সঙ্গে হেফাজতকর্মীদের সংঘর্ষ চলে। মতিঝিল, পল্টন ও আশপাশ এলাকায় ফুটপাতের শত শত দোকান ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করে কওমি শিক্ষার্থীরা। তাণ্ডবের শিকার হয় আশপাশের অনেক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা।
শাপলা চত্বরের সেই সমাবেশে হেফাজত আমির আহমদ শফীরও যোগ দেওয়ার কথা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি লালবাগের একটি মাদ্রাসাতেই অবস্থান করেন।
সেই রাতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানে হেফাজতকর্মীদের মতিঝিল থেকে তুলে দেওয়া হয়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, হেফাজতের তাণ্ডবে সেদিন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ৩৯ জন নিহত হয়েছেন।
২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক ওয়াজে নারীদের নিয়ে আহমদ শফীর বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ওই বছরের শেষভাগে আহমদ শফীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান দেশের নারীনেত্রী ও অধিকারকর্মীরা।
পরে ওই বছরের ২ নভেম্বর এক সভায় আহমদ শফী বলেন, তিনি মহিলাদের ‘রানীর সাথে’ তুলনা দিয়েছেন, ‘ফুলের সাথে’ তুলনা দিয়েছেন।
“এ কথা বুঝে নাই। সরকারও বুঝে নাই। সরকারের মন্ত্রীরাও আমার কথা বুঝে নাই। আমি মহিলাকে তেঁতুলের মতো বলেছি, তেঁতুল বলি নাই। এরা কিছু বুঝে না।”
কিন্তু এরপরও ২০১৯ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসার এক মাহফিলে আহমদ শফী মেয়েদের স্কুল-কলেজে না দিতে এবং দিলেও সর্বোচ্চ চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর ওয়াদা নেন বলে গণমাধ্যমে খবর আসে।
এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার মধ্যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে আহমদ শফী বলেন, তার বক্তব্য ‘বিকৃত’ করায় সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি নারী শিক্ষার বিরোধী নন, ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে স্কুল-কলেজে লেখাপড়ায় আপত্তি জানিয়েছেন।
এর আগে ২০১৭ সালে মোবাইল ফোনকে ‘ইহুদিদের তৈরি বিধ্বংসী মারণাস্ত্র’ আখ্যায়িত করে সন্তানদের এ থেকে দূরে রাখার নসিহত দেন শাহ আহমদ শফী। পরের বছর তার মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মোবাইল সেট জব্দ করে তা ধ্বংস করে কর্তৃপক্ষ।
সে সময় হেফাজত আমির আহমদ শফী এক বিবৃতিতে তাদের ‘দাবি মেনে’ স্কুলের পাঠ্যবই থেকে ‘নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দু তত্ত্বের বিষয়বস্তু’ বাদ দেওয়ায় সরকারের প্রশংসা করেন।
শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলাম বাংলা নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখ পালনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিল। তাদের দাবির পর ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক লেডি জাস্টিসের আদলে গড়া ভাস্কর্য সরিয়ে নেয় সরকার।
সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিতে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও আলেমদের উপস্থিতিতে শোকরানা সমাবেশ করে কওমির ছয় বোর্ডের সমন্বিত সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যাহ বাংলাদেশ। ওই সংস্থার চেয়ারম্যান আহমদ শফী সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ‘শুকরিয়ার স্মারক’ তুলে দেন।
কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি আদায়কেও আহমদ শফীর বড় সাফল্য হিসেবে দেখেন তার অনুসারীরা।
সালাউদ্দিন নানুপুরী বলেন, “ইসলামী দ্বীন প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অবদান রেখেছেন তা গত ৫০ বছরে কেউ রাখেননি। হাটহাজারী মাদ্রাসার উনি যে খেদমত করেছেন তা অনস্বীকার্য।”
তবে জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে সেই মাদ্রাসাতেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দেখতে হয়েছে ‘বড় হুজুর’ শফীকে।
বয়স হওয়ায় হাটহাজারী মাদ্রাসায় শফীর উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি বিরোধ দেখা দেয়। মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম বা সহকারী পরিচালকের পদে থাকা হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী ছিলেন শীর্ষ পদের অন্যতম দাবিদার, কিন্তু শফী সমর্থকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ১৭ জুন তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তাদের অন্য দাবির মধ্যে ছিল- আনাস মাদানি কর্তৃক অব্যাহতি দেওয়া তিন শিক্ষককে পুনর্বহাল, আনাসের নিয়োগ দেওয়া সব ‘অযোগ্য ও বদ আখলাকের’ শিক্ষক ও স্টাফকে ছাঁটাই এবং মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর সব ধরনের জুলুম ও হয়রানি বন্ধ করা।
এই পরিস্থিতিতে সরকার বৃহস্পতিবার হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও অধ্যক্ষকে বৃহস্পতিবার একটি চিঠি পাঠায় কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। ওই চিঠি পাওয়ার পর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে রাতে আহমদ শফীর নেতৃত্বে বৈঠকে বসে মাদ্রাসার শূরা কমিটি।
সেখানে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন ‘বড় হুজুর’ শফী। বৈঠকে শফীর ছেলেসহ দুই শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় দৃশ্যত আহমদ শফীর সুদীর্ঘ দিনের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে।
সেই রাতে মাদ্রাসাও ছাড়েন অসুস্থ আহমদ শফী, ভর্তি হন হাসপাতালে। পরে তাকে হেলিকপ্টারে করে আনা হয় ঢাকায়।
গত কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকবার অসুস্থ হলেও প্রতিবারই শফী সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন তার অর্ধশতকের কর্মস্থল হাটহাজারী মাদ্রাসায়। শনিবার তিনি সেখানে ফিরবেন কফিনবন্দি হয়ে।