বিক্ষোভের পর বন্ধ হল হাটহাজারী মাদ্রাসা

চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানিকে অপসারণসহ ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ ও উত্তেজনার মধ্যেই কওমি মাদ্রাসাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2020, 01:58 PM
Updated : 17 Sept 2020, 07:33 PM

এ বিষয়ে হাটহাজারীর ওই মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও অধ্যক্ষকে বৃহস্পতিবার একটি চিঠি পাঠিয়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ।

সেখানে বলা হয়েছে, মহামারীর মধ্যে কয়েকটি শর্তে কওমি মাদ্রাসাগুলোর কিতাব বিভাগের কার্যক্রম শুরু ও পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

“কিন্তু আরোপিত শর্তসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালিত না হওয়ায় চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসাটি পুরানাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হল।”

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সেই ছুটি আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে বলে জানানো হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।

তবে কওমি মাদ্রাসাগুলোর আবেদনে গত অগাস্টের শেষে তাদের ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ ডিগ্রি ও মাস্টার্স পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। যদিও অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মত আলিয়া মাদ্রাসাগুলো এখনও বন্ধ রয়েছে। 

হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো ও বড় কওমি মাদ্রাসা। সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সেখানে অধ্যয়ন করে।

এ মাদ্রাসার মহাপরিচালক (মুহতামিম) শাহ আহমদ শফী বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেরও (বেফাক) সভাপতি। ৯৫ বছরের বেশি বয়সী শফীই ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে আসা হেফাজতে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা।

দীর্ঘদিন ধরে এর মহাপরিচালকের পদে থাকা আহমদ শফীকে দেশের কওমি শিক্ষার্থীরা ‘বড় হুজুর’ বলে সম্বোধন করেন। তবে শফীর বয়স হওয়ায় এই মাদ্রাসার কর্তৃত্ব নিয়ে সম্প্রতি বিরোধ দেখা দেয়।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় বুধবার আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানিকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করে একদল শিক্ষার্থী

গত জুন মাসে মাদ্রাসার শুরা কমিটির বৈঠকে জুনাইদ বাবুনগরীকে সহকারী পরিচালেকের পদ থেকে সরিয়ে শেখ আহমদকে নিয়োগ দেওয়ার পর আহমদ শফীর সমর্থকদের সঙ্গে বাবুনগরী পক্ষের বিরোধ প্রকাশ্য হয়। তারই জের ধরে বুধবার ওই মাদ্রাসায় শফীর ছেলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয় বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

মহামারীর শুরুতে মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকা অবস্থায় ছাত্রদের বেশিরভাগই মাদ্রাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। পরে আবার মাদ্রাসা খুললে তারা ফিরে আসেন।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানান, বুধবার দুপুরে হঠাৎ করেই কয়েকশ শিক্ষার্থী মাদ্রাসার ভেতরে বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক (শিক্ষা) আনাস মাদানির পদত্যাগ দাবি করে শ্লোগান দিতে থাকেন। এসময় তারা ছয় দফা দাবিও তুলে ধরেন।

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আনাস মাদানির কক্ষ এবং জুনাইদ বাবুনগরীর পদে নিয়োগ পাওয়া শেখ আহমদের কক্ষও ভাংচুর করে। এক পর্যায়ে তারা মাদ্রাসার সামনে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কে অবস্থান নিলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মাদ্রাসার ভেতরে বৃহস্পতিবারও উত্তেজনা চলছে, পুলিশ সদস্যরা বাইরে অবস্থান নিয়ে আছেন।

বিক্ষোভে সঙ্গে ভাংচুরও

আনাস মাদানির অপসারণসহ ছয় দফা দাবিতে হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার (বড় মাদ্রাসা) শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ চালিয়ে যায়।

এদিন বেলা ১২টায় শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার ভেতরে পুনরায় বিক্ষোভ শুরু করে বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। 

এসময় মাদ্রাসার মূল ফটকের বাইরে ও আশেপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা ভেতরে ঢোকেনি। 

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার (উত্তর) মশিউদ্দৌলা রেজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুপুর থেকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ভেতরে বিক্ষোভ শুরু করে। পুলিশ মাদ্রাসার বাইরে অবস্থান নিয়েছে। ভেতরে কী হয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের জানা নেই।”

বুধবার বিক্ষোভের পর রাতে মাদ্রাসার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের এক জরুরি সভায় আনাস মাদানিকে সহকারী পরিচালক (শিক্ষা) পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের খবর শুনে বিক্ষুব্ধরা শান্ত হয়েছিল।

মাদ্রাসার শুরা কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে আনাস মাদানির অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি জানানো হয়। পরবর্তীতে আনাস মাদানিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি মর্মে কথা ছড়িয়ে পড়লে আজ আবারও বিক্ষোভ শুরু করে তারা।”

চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় বুধবার আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানিকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করে একদল শিক্ষার্থী

শূরা সদস্য মাওলানা নোমান ফয়েজী বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছেন আনাস মাদানিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেটি ঠিক। কিন্তু অন্যান্য দাবি আদায়ের জন্য পুনরায় বিক্ষোভ শুরু করে।”

বিক্ষূব্ধদের বিলি করা লিফলেটে অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে- আনাস মাদানি কর্তৃক অব্যাহতি দেওয়া তিন শিক্ষককে পুনর্বহাল, আনাসের নিয়োগ দেওয়া সব ‘অযোগ্য ও বদ আখলাকের’ শিক্ষক ও স্টাফকে ছাঁটাই, অসুস্থ আহমদ শফীকে সম্মানজনকভাবে অব্যাহতি দিয়ে নতুন একজনকে মহাপরিচালক নিয়োগ এবং মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর সব ধরনের জুলুম ও হয়রানি বন্ধ করা। 

আহমদ শফী মাদ্রাসার শিক্ষকদের বৈঠক ডেকে দুই মাসের জন্য মাদ্রাসা বন্ধ করে দিচ্ছেন বলেও খবর ছড়িয়ে পড়লে, যাতে উত্তেজিত হয় বিক্ষুব্ধরা। তারা মাদ্রাসার কয়েকটি কক্ষ ভাংচুরও করে।

এদিকে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ মাদ্রাসা বন্ধ করার নির্দেশনা দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতে শুরা কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকা হয় বলে জানান ফয়েজী।

তবে তিন বলেন, মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য তার কাছে নেই।

হাটহাজারীর ইউএনও রুহুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাদ্রাসা বন্ধ করার বিষয়ে সরকারি আদেশটি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

“আশা করি উনারা সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যবস্থা নেবেন। তা না হলে আমরা নিয়ম অনুসারে ব্যবস্থা নেব।”

মাদ্রাসায় ভাংচুরের বিষয়ে রুহুল আমিন বলেন, “কিছু লোকজন উগ্র আচরণ করেছেন। ভাংচুরের বিষয়টি জেনেছি।”