বর্তমানে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিচারাধীন এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বায়েজিদ থানার এসআই দীপঙ্কর চন্দ্র রায়কে এরইমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে বলে সিএমপির নতুন কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলার বাদী অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া জয়নালকে অন্তর্ভুক্ত করতে আদালতে আবেদন করেছেন। আগামী ১৩ অক্টোবর মামলার পরবর্তী শুনানির দিনে আদালত হয়ত এ বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন।”
এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে এই আইনজীবী বলেন, “পুলিশ কীভাবে অভিযোগপত্রে জীবিত আসামিকে মৃত দেখাল সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।”
এই মামলার ঘটনার সূত্রপাত প্রায় দুই বছর আগে। নাতিকে যৌতুকের জন্য মারধরের প্রতিবাদ করায় তাকেও মারধর করা হয় জানিয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে আদালতে অভিযোগ করেন নগরীর বায়েজিদ থানার রৌফাবাদ এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব শাহ আলম। অভিযোগ আমলে নিয়ে আদালত বায়েজিদ থানায় তা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করার আদেশ দেয়।
মামলায় শাহ আলম অভিযোগ করেন, মারধর করায় থানায় নাতি জামাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। এর জের ধরে তার বাসায় হামলা চালিয়ে আসামিরা তাকে মারধর করেন। এই মামলায় নাতি জামাই মো. নাসিমসহ সাতজনকে আসামি করা হয়।
প্রায় এক বছর ধরে তদন্ত শেষে এসআই দীপঙ্কর চন্দ্র রায় গত বছরের ১৫ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। সেখানে ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হলেও মামলার দ্বিতীয় আসামি জয়নালকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
তিনি অভিযোগপত্রে লেখেন, মো. জয়নাল (১৯), পিতা: আবদুল জলিল পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
অভিযোগপত্রে মৃত্যুর কাগজপত্র জমা দেওয়ার কথা উল্লেখ করলেও কখন, কীভাবে এবং কোথায় বন্দুকযুদ্ধে জয়নাল মারা গেছেন তা লেখা হয়নি।
দীর্ঘদিন বিষয়টি অগোচরে থাকলেও করোনাভাইরাসজনিত কারণে বিরতির পর সম্প্রতি আদালতের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হলে আসামি জয়নালের হাজিরা দিতে আসাটা অনেকের নজরে আসে।
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দীপঙ্করকে বরখাস্ত করা হয়। নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উত্তর জোনের উপ-কমিশনারকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন সদ্য বিদায়ী সিএমপি কমিশনার মাহবুবর রহমান।
অপরদিকে তদন্ত কর্মকর্তা দীপঙ্কর ‘গাফিলতি’ করে দায়সারা অভিযোগপত্র দিতে গিয়ে দুই জয়নালের মধ্যে তালগোল পাকিয়েছেন বলে ধারণা তাদের।
“বন্দুকযুদ্ধে নিহত জয়নাল ২০১৯ সালের একটি মামলার আসামি। আর এসআই দীপঙ্করের তদন্ত করা মামলার আসামি জয়নাল ভিন্ন ব্যক্তি,” বলেন নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা।
শাহ আলমের করা মামলার আসামি জয়নাল বর্তমানে জামিনে আছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যে মামলায় তিনি আসামি হয়েছেন সেটা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ের’ মামলা। এই মামলায় ২৩ দিন কারাগারে ছিলেন তিনি।
“কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে আমি প্রত্যেকটি ধার্য্য তারিখে আদালতে হাজিরা দিয়েছি। অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। সর্বশেষ করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর আগেও ফেব্রুয়ারি মাসে আমি হাজিরা দিয়েছি।”
পুলিশ অভিযোগপত্রে তার বন্দুকযুদ্ধে ‘নিহত’ হওয়ার কথা লেখার বিষয়ে ‘কিছুই জানেন না’ বলে দাবি করেন জয়নাল।
তার আইনজীবী নূরজাহান ইসলাম মুন্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার মক্কেলের মামলাটি ২০১৮ সালের। আর বন্দুকযুদ্ধের যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে সেটা ২০১৯ সালের মামলা। তদন্ত কর্মকর্তা মামলার নম্বরও ভুল করেছেন। আবার দুইজনের বাবার নামের ভিন্নতা থাকলেও আমার মক্কেল বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন আইও।”
তদন্ত কর্মকর্তার ‘গাফিলতিতে’ এই ধরনের একটা ভুল হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
আইনজীবী নূরজাহান বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তা গুরুত্ব সহকারে সরেজমিনে তদন্ত না করে হয়ত সোর্সের মাধ্যমে তদন্ত করে এই ধরনের ভুল করেছেন। এখন আমার মক্কেলকে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে কথা বলা হচ্ছে। তাকে সন্ত্রাসীও বলা হচ্ছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে থাকা মামলাটি পারিবারিক বিরোধ নিয়ে।
“আমি শুনেছি মামলার বাদী গত ৩ সেপ্টেম্বর আদালতে আবেদন করেছেন আমার মক্কেলকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। সেটা তিনি করতেই পারেন। পুলিশও তাকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করতে পারে। কিন্তু ২০১৯ সালের বন্দুকযুদ্ধের মামলার সাথে তাকে কোনোভাবে জড়ানো ঠিক হবে না।”
তবে অভিযোগপত্রে জয়নালের ‘মৃত’ হওয়ার পেছনে অন্য কারণ রয়েছে বলে মনে করেন বাদী শাহ আলম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসামি জয়নালের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে আইও এই কাজ করেছেন। স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিগত সহকারী জয়নালের পক্ষ নিয়ে পুলিশের মাধ্যমে এ কাজ করিয়েছে।”
তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া এবং তদন্তের বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেননি বলেও অভিযোগ করেন শাহ আলম।
এ ঘটনায় ওই পুলিশ কর্মকর্তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন এই প্রবীণ।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে সদ্য যোগদানকারী কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে বিষয়টি তার নজরে আনা হয়।
জবাবে তিনি বলেন, “বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এটি প্রফেশনালি ডিল করা হচ্ছে। কোনো ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না।”